আদুরে রাঙা পাথুরেডাঙায়



উৎসর্গ: আমার প্রিয় পাঠক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে।
ভূমিকা: অনুভূতির তাড়নায় জেনেশুনে বিষ পানেও পিছ - পা হন না অনেক ভালোবাসার কাঙাল জন। Anthony Bourdain - এর ভাষার বাংলা তর্জমায়, " ভ্রমণ সব সময় আরামদায়ক হয় না। কখনও কখনও এটি ব্যথা দেয়,এমন কি এটি আপনার হৃদয় ভেঙে দেয়। কিন্তু এটি  সঠিক,ভ্রমণ আপনাকে বদলে দেয়। এটি আপনার স্মৃতিতে, আপনার চেতনায়, আপনার হৃদয়ে ... চিহ্ন রেখে যায়..."

' চলতি পথে প্রিয়া'-র জীবনের চলার খন্ড, ক্ষুদ্র পথের অংশগুলিও অনেকানেক চড়াই - উৎরাই অতিক্রান্ত। পথটি পুরুলিয়া জেলার মাটির ন্যায় কাঁকরময়! সেখানে প্রিয়া যেন পথের পাঁচালীর অপু। এই অপু Oscar Wilde - এর নির্দেশের মান্যতা দেয়, ( বাংলা তর্জমায় " কোন অজুহাত ছাড়া জীবনে বাঁচুন, কোন অনুশোচনা ছাড়া ভ্রমণ করুন ..."। 

আর বাঁচতে গেলে সুন্দরভাবে বাঁচাই শ্রেয়। ' বোঝাপড়া ' য় রবি ঠাকুর বলেই গিয়েছেন, "... মরণ এলে হঠাৎ দেখি/ মরার চেয়ে বাঁচাই ভাল। " তাই পাথুরে ডাঙার পাথরের আতিশয্য ও পথ - কাঠিন্য , মোরগের যন্ত্রণাদায়ক লড়াই, জল - কষ্ট ও যাবতীয় প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যকৃত নানান সমস্যাকে সুখকর, আদরণীয় আবেগের প্রলেপে মসৃণ ও পেলব করে তুলে আত্মজনের সেবা ভ্রমণক্ষেত্রের তালিকায় পূরুলিয়াকে নিবন্ধীকরণের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রয়াস " আদুরেরাঙা পাথুরে ডাঙায়"।

দুঃখ-কষ্টকে পরিহার করে সুখান্বেষের ধারাবাহিক প্রয়াসের নামই জীবন। ভ্রমণপথের এই রুক্ষ ও শুষ্ক ঠিকানা বহুজনের আকর্ষণের ক্ষেত্র হয়ে উঠলে সার্থক এই কলম।

ভ্রমণের বন্ধুর, বঙ্কিম,প্রস্তরাকীর্ণ পথটি সুন্দর করে তুলতে সাথী হোক বাংলায় রূপান্তরিত কনফুসিয়াসের সেই বাণীটি __ " যেখানেই যাওনা কেন, মনকে সাথী করে নিয়ে যেও...."।

ঋণ স্বীকার করি ত্রয়ী ( ভ্রমণ দল ), আনন্দবাজার পত্রিকা, গুগলস্, লিপিকা,নীরব আলোর সম্পাদনা দপ্তর,নীরব আলো প্রকাশন ও চলতি পথে প্রিয়ার অপরাপর সকল বন্ধুর নিকট।

ধন্যবাদ।
🙏 

শ্রীমতি সুপ্রিয়া গঙ্গোপাধ্যায় 
মে,2025
*****************************************************

2024 -এ ডিসেম্বরের তিন তারিখে ABP আনন্দের সান্ধ্য খবরে নজর পড়তেই  আপাত পাণ্ডববর্জিত গুণান্বিত ও পুরুলিয়া নামাঙ্কিত আমার প্রিয় আদুরে রাঙা পাথুরেডাঙ্গার নানান  দুঃখজনক পরিস্থিতি ব্যথিত করল আমাকে _ গত বছর করোনা ভু-আবহ কাটিয়ে উঠেছি সবে;সেই  মুহূর্তে সকল দুঃখ,কষ্ট, বেদনাকে ভুলিয়ে আনন্দ-সম্ভোগের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল এতদঞ্চলের প্রকৃতি নিংড়ানো সৌন্দর্য্য!

ঝাড়খণ্ডের রাজ্য ফুল ' পলাশ '। আর পুরুলিয়ায় প্রচুর পলাশ হয়; বসন্তে নতুন রাগে রেঙ্গে ওঠে পুরুলিয়া। লাল পলাশে রাঙা পুরুলিয়াকে তাই বসন্তের অগ্রদূত বলে।
 কবিগুরুর ভাষায়,
"সেই পুরাতন সেই চিরন্তন অনন্ত প্রবীণ/ নব পুষ্পরাজি /বর্ষে বর্ষে আনিয়াছ,/তাই লয়ে আজও পুনর্বার/ সাজাইলে সাজি।"
'গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ'শুধু কবিগুরুর নয়,মন ভোলায় আমাদেরও।'বাহামণি'-র বাপের ঘরটো ইদিক পানেই হবেক_পলাশ বনী।পুরুলিয়ার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একটি আনন্দ উৎসব 'বাহা'_বসন্ত উৎসব। মহুয়া, বুনো ফল ও ফুলের প্রথম কুঁড়ি আসার সময় কার প্রার্থণা।সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি অস্ট্রেলীয় (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড)। বাহা মণিদের গাঁয়ের সাঁওতালদের বছরে মাস শুরু হয় ফাল্গুণে।অতঃপর বারো মাসে তেরো পার্বণ চলে।লীনাদির ' ইষ্টিকুটুম '-এর বাহামণির নামের মধ্যেই জড়িয়ে বসন্তের আনন্দ উৎসবের ছোঁয়া।স্টার জলসা কর্তৃক একদা সম্প্রচারিত ধারাবাহিকটির 'সাঁওতালী নায়িকার পলাশবনী'-তে পৌঁছাবার ইচ্ছের বাস্তব রূপায়ণের প্রয়াসজনিত কাহিনীটি লিপিবদ্ধ আমার ডায়েরীতে।সেখান থেকেই দু-কথা বিনিময় করছি পাঠক বন্ধুদের সঙ্গে।

যেদিকে যাই,যতই যাই, ততই ঘনতর হতে চলেছে পাহাড়ী জংলী রাস্তার উভয় পাশে পলাশের আগুন রাঙা সম্ভার!' বাহার ঘরটো ' খুঁজে পাই,না পাই_ পথ হারাবো বলে এবার পথে নেমেছি../ সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি। /.../ চেনাশোনা জানার মাঝে কিছুই চিনিনি যে../ অচেনায় হারায়ে পথ আবার খুঁজেনি যে.../...

14- ই মার্চ,2023:

কাকভোরে প্রস্তুত হয়ে পড়েছি।ঘরের কাছেই যে পথে কোনও দিন যাওয়া হয়নি সে পথের পথিক হয়েছি।'ত্রয়ী'- র ছত্রছায়ায় চলেছি।মনের ভিতরে অন্য কোনও ব্যক্তি বাস করেন আর সেই হিসেবে একই প্রকৃতি তিনজনের হৃদয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন মাত্রার লহরী তুলেছে,অবশ্যই।

আগে থেকেই ট্রেনের টিকিট ও হোটেলের রুম সংরক্ষিত ছিল। সেমোতাবেক, সাঁতরাগাছি থেকে ' রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস'-এ চড়ে পড়েছি।বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি 5:30am - এ আর ট্রেনে চড়লাম 6:25am-এ।ট্রেনটি নির্ধারিত সময়েই ছাড়ল।খুব ভাল লাগছে ___ আমাদের কামরায় কিশোরীদের কিচিরমিচির আর তার সঙ্গে কয়েকজন পুরুষ স্টাফ সহ লেডি-ব্রেবোর্ণের Geography বিভাগের অধ্যাপিকাদের তিনজনের একটি দল!ওঁরা সব মিলিয়ে প্রায় জনা চব্বিশেক।শিক্ষার্থীদের হই-চই আমার ফেলে আসা শিক্ষকতা জীবনের একটি অধ্যায়কে মনে করিয়ে দিল। শুধু তাই নয়;আরও দূরে বয়ে নিয়ে গেল _ সেই আমার কৈশোরে।এরকম ট্রেনে করে excursion হয়নি।একাদশ শ্রেণীতে গিয়েছিলাম কলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গণে।আর স্নাতক স্তরে জুলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে লাক্সারি ট্রাভেল বাসে নামখানা,ও পরে লঞ্চে সুন্দরবনের ভগবত পুরে 🐊 Crocodile project-এর প্রাকটিক্যাল তথ্য সংগ্রহ করতে।

ঘরে ঘরে ও প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুজো অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলী দানের সময়ে পলাশপ্রিয়া বিদ্যাদেবীর পায়ে নিবেদনে ধন্য হতে বহু কষ্টে সংগ্রহ করতে হয় ওই গন্ধহীন অথচ সুন্দর পলাশ।মাঝে মধ্যে ট্রেনের বাতায়ন পথে লুকোচুরি খেলতে দেখছি তাদের কতিপয় দলকে।এই আনন্দঘন মুহূর্তে অধ্যাপিকাত্রয়ের কথোপকথনে আপ্লুত হবার পূর্বেই ওঁরা ও আমরা অবতরণ করলাম পুরু লিয়া স্টেশনে।আমাদের জন্য একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবার কথা।ফোন মারফৎ যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট গাড়িটিতে চড়ে বসেছি।গন্তব্য সোজা হিলটপ, অর্থাৎ অযোধ্যার শিখর স্থানে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রিসর্টে।ইতিমধ্যে ট্রেনেই টুকিটাকি বিস্কুট, চাল ভাজা ও চা সহযোগে জলযোগ হয়ে গিয়েছিল।এবার রিসর্টে বিভাবরী স্যুইটে আমাদের স্থান সংকুলান হল।পরিপাটি সাজানো-গোছানো বিভাবরীর দোতলায় আমাদের আশ্রয় মিলেছে। সিঁড়িগুলি খাঁড়া হওয়ায় ওঠবার সময়ে সামান্য কষ্ট হলেও ইতিপূর্বেই বিভাবরীর গেটে আমার অতি পরিচিত এক দাদার নাম দেখে অজানা অচেনা পাহাড়ী অঞ্চলটিকে বড়ই আপনার বলে মনে হচ্ছে।দাদাটি আমার একার নয়,পাঠকবন্ধুদেরও পরম আপনার জন_ উদ্বোধক শ্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। যদিও আজ তিনি অন্য লোকে।একটি লজের নাম দেখে বুঝলাম, পদ্ম-লোচনের নাম কানানয়ন রাখবার ন্যায় ভ্রান্তি ঘটেছে; কারণ পয়সা খরচ করে পাহাড় ঠেঙ্গিয়ে উপরন্তু ভ্রমণবিলাসীতার উচ্ছ্বাসসহ আগত কোন পর্যটকই বা জেনেশুনে 'উপেক্ষিতা'  লজে থাকতে চাইতে পারেন!

লাঞ্চ সেরে চলেছি আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ী তে চড়ে কাছেপিঠের কয়েকটি স্পট দর্শনে।

চালক আমাদের মুরগুমা লেক,ময়ূর পাহাড় আর সুইসাইড পয়েন্টে নিয়ে যাবার কথা ঘোষণা করবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ,'সুইসাইড পয়েন্ট দেখব না।কোথায় মনটা হালকা করতে ভ্রমণে এসেছি,সেখানে মন ভারী করা আত্মহত্যা কেন্দ্র দেখতে যাব কোন দুঃখে!' নাছোড়বান্দা চালক জোরজবরদস্তি ঐ পয়েন্টে নিয়ে যাবেই যাবে।

মুরুগুমা লেক: বাইরে কাঠফাটা রোদ,ভিতরে AC-সহ আমরা তিন জন আর উত্তম।বাইরে পাহাড়, শাল, মহুল, পলাশের স্নিগ্ধতা আর পাতাঝরা অসংখ্য নাম জানা ও অজানা গাছ,পাখি, আর মাঝেমধ্যে গাড়ী ভর্তি পর্যটক অথবা গাছকাটা কাঠ মাথায় চলা পথচারী।

ছোটনাগপুর মালভূমির  অন্তর্গত পুরুলিয়া জেলার ভু - প্রকৃতি পশ্চিমবাংলার অন্যান্য জেলাগুলি হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।এই জেলার উচু নিচু ভূ-প্রকৃতি গঠনগত  বিচারে অন্য সব জেলা থেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে।ঢেউ খেলানো জমির উপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টিলা ও পাহাড়ের অবস্থান।ফলতঃ নদীখাতগুলি অত্যন্ত গভীর।মৃত্তিকাও অন্যান্য জেলার তুলনায় রুক্ষ।নদী তীরবর্তী কিছু জায়গা বাদ দিলে বাকি সমস্ত এলাকাতেই কাঁকর আর পাথর, __যেন পাথুরে ডাঙা!অবশ্য কিছু কিছু জায়গায় পরিলক্ষিত হয় বেলে ও দোয়াশ মাটির স্তরও।

কিছু পানীয় ও হস্তশিল্পজাত সামগ্রীর সম্ভারে সজ্জিত এক লাইন কি দু'লাইনের চার-পাঁচটি করে দোকান।ওগুলির দিকে তাকিয়ে চলতে চলতে পদব্রজেই এগিয়ে চলেছি এবড়ো-খেবড়ো ও ক্রমশঃ উচ্চ, বুকে হাফ ধরা রাস্তা ধরে মুরুগুমার আহ্বানে।এখানে কুল গাছ অনেক। পাতাঝরা গাছ অধিক_শাল,পলাশ তো রয়েছেই।

পাহাড়ের কোলে ছবির মত সাজানো এক আদিবাসী গ্রাম মুরুগুমা।পুরুলিয়ার শহর ছাড়াতেই দৃষ্ট লাল পলাশের উচ্ছ্বাস_এখানে আক্ষরিক অর্থে 'অতিরঞ্জিত'।নেড়া পাহাড়ের মাঝেমধ্যে সবুজের ছোঁয়া।পাহাড়ের তলায় নানান নামের আদিবাসী গ্রাম।মাটির নিকোনো দেওয়ালে ছবির আঁকিবুঁকি।মাঠ পেরিয়ে আদিবাসী রমনীর কলসী মাথায় জল আনতে যাওয়া দেখতে দেখতে শাল-পিয়ালের জঙ্গুলে রাস্তায় পড়েছি।

আঁকাবাকা পিচ ঢালা রাস্তার প্রতিটি বাকেই দৃশ্যপট বদল।সহসা পাহাড়ের কোলে সুন্দর এক জলাধারের সাক্ষাৎ। সাহাবজোর নদী ঘিরে এক সুন্দর বাঁধ। আর সেই বাঁধের ধারেই মুরুগুমা গ্রাম।শান্ত লেকের টলমল জলে এসে পড়েছে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। সন্ধ্যে নামলে মাদলের বোল ভেসে আসে মুরুগুমা গ্রাম হতে।সামিল হন পর্যটকেরাও। রয়েছে গুররাবেড়া গ্রাম ও গিরগীরা নদীর সুন্দর ঝরনা! শহর হতে সামান্য দূরে লাল পলাশ আর পাহাড়ঘেরা সবুজের ছোঁয়া মন মাতিয়ে তোলে।

শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা যে কোনও সময় হোক না কেন পুরুলিয়ার সৌর্ন্দয্য নামী দামী ভ্রমণক্ষেত্রকেও হার মানায়।'পুরুলিয়া ' শব্দটি শুনলেই হাতছানি দেয় পলাশ ফুল, লালমাটি অথবা চরিদা গ্রাম,কিম্বা অযোধ্যা পাহাড়।প্রচুর নদী ও স্রোত রয়েছে।তাই সেখানে বেশ কিছু বাঁধও রয়েছে। মুরুগুমা গ্রামের বাঁধটি সাহাবজোর নদীর উপর অবস্থিত।স্থানীয় ভাষায় ' মুরুগুমা '- র অর্থ ' ময়ূরদের জন্য বাড়ি '।ড্যামটির স্বচ্ছ নীল জল দেখে মনে হচ্ছে,আন্দামানের কোনও এক দ্বীপে রয়েছি।আবার ঘন বন ও অনেক ছোট ছোট সবুজ পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ড্যামটির অপরূপ সৌন্দর্য্য বলছে দার্জিলিংয়ের কথা।

মুরুগুমা গ্রাম এবং বাঁধটি অযোধ্যার পাদদেশে এবং বিখ্যাত উপজাতি গ্রাম বেগুনকোদারের বেশ কাছেই অবস্থিত। পুরো গ্রামটির সঙ্গে মুরুগুমা বাঁধ সৃষ্ট দুর্দান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আমাদের ন্যায় শহুরে পর্যটকের ক্লান্ত দৃষ্টিকে করে তুলেছে প্রশান্ত।

স্থানীয় জনগণের ব্যবহারের জন্য মুরুগুমা বাঁধটি জল সঞ্চয় করে এবং সেই জল মূলত কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। মুরুগুমা গ্রাম ছাড়াও বাঁধের আশপাশে রয়েছে অন্যান্য উপজাতি অধ্যুষিত গ্রাম_মামুদি,বামনি,লেভা,লক্ষীপুর, গুরবেরা, ইত্যাদি।পাথুরেডাঙ্গার উপজাতীয় গ্রামের হুবহু নিখুঁত প্রাকৃতিক ছবি আঁকা রয়েছে এইখানেই।

ময়ূর পাহাড়: 

প্রকৃতিপ্রেমী ও ট্রেকারদের পছন্দের ক্ষেত্র এই ময়ূর পাহাড়।পাহাড়ের উপর থেকে দৃশ্যমান পাথুরেডাঙ্গার নিদারুণ সৌর্ন্দয্য মুগ্ধ করে পর্যটকদের।পাথুরে পথ বেয়ে উপরে উঠতে হয় গাছগাছালি,ঘাস,লতাপাতা,বড় বড় বোল্ডারের পাশ দিয়ে।খুব একটা খাঁড়া নয় এই পথ। সামনেই পাথুরে চত্বর; অতঃপর খাঁড়া খাদ।জায়গাটি একদা বিখ্যাত ছিল ময়ূরের ঘোরাঘুরির জন্য।

এখান থেকে পাথুরেডাঙ্গার এতদঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ক্যামেরাবন্দী করা সম্ভব।বর্ষাকালে এলে থাকত মেঘেদের সাথে একান্তে মোলাকাতের সুযোগ।

ময়ূর পাহাড়ে একটি প্রাচীন গুহা আছে। খুব সুন্দর; নাম যোগিনী গুহা।সম্ভবতঃ পাহাড়ের বাগাল ডুংরী স্তরেই এটি অবস্থিত। এটিও প্রতীক্ষায় থাকে পর্যটকের সান্নিধ্য লাভের আশায়। সাঁওতালী ভাষায় 'শুখিন' শব্দের অর্থ 'যোগিনী'।তাই আমি প্রথমে ওটিকে শকুনের বাসস্থল ভেবে ভ্রম করলেও আমাদের শিক্ষিত চালক - কাম - গাইডের মাধ্যমে আসল অর্থটি জেনে গিয়েছি।এক বৃদ্ধা মহিলা বাস করতেন এখানে।আগেকার দিনে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব ছিল না;তাই গাছ-গাছালি হতে প্রাপ্ত তাঁর বানানো ওষুধ নিতেন রোগী তরফের মানুষ জন।আর তিনি ভিক্ষায় বেরোতেন গুহার মুখে পাথর চাপা দিয়ে,আবার প্রবেশ করতেন সেই পাথর সরিয়ে।গুহার ভিতরটিকে যথাসাধ্য পরিচ্ছন্ন রাখতেন তিনি।আজ নেই সেই জীবিতা দেবী; রয়েছে তাঁর স্মৃতি-বিজরিত এই প্রাকৃতিক গুহাটি।

' ত্রয়ী '- র সিদ্ধান্তে সহমত হয়ে পরবর্তী সাংঘাতিক নামযুক্ত দর্শনীয় স্থান _ সুইসাইড পয়েন্ট বা আত্মহত্যা - বিন্দুতে গমনে উদ্যত হয়েছি। পুরুলিয়া স্টেশন থেকে 50কিমি আর ড্যাম থেকে কিমি দেড়েক পথ।সমতল থেকে পাহাড়ী চড়াইয়ে পাথর কাটা রাস্তা_ সবুজের বুক চিরে ক্রমশঃ উপরে উঠছে। পিচগলা হাইওয়ে।পড়ন্ত বিকেলে আকাশে রঙের আঁকিবুকি।নীল ক্যানভাসে বালুকারাশির মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাল,গেরুয়া, কমলা,হলুদ, সাদা রংয়ের ভেলা; সীমান্তরেখায় সবুজ গাঢ় থেকে যেন আরও আরও সবুজ!বিদ্যুৎ স্ফূলিঙ্গে জানান দিচ্ছে কাচ অপেক্ষাও স্বচ্ছতর জলাধারের কথা। অযোধ্যায় নিশ্চুপে প্রকৃতিকে নিয়ে যেন শীতঘুমে মুরগুমা। সকালে এক,সন্ধ্যায় আরেকরকম।প্রকৃতিএখানে বহুরূপী_রূপ বদলায় ক্ষণে ক্ষণে।শাল, সেগুন ও মহুলের ঘন জঙ্গলে অবিশ্বাস্য আবিস্কার ' সুই সাইড পয়েন্ট '।সশরীরে স্বর্গের কাছাকাছি চলে এসেছি, বোধ হচ্ছে!

ছবি শিকারী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য মুরগুমা সুইসাইড পয়েন্ট এককথায়,'কল্পতরু '; তাদের মনোবাসনা পূরণ হবেই হবে।সঙ্গে গাড়ি আছে, তাই, অন্যথায় হেঁটেও চলে আসতে পারতাম এটুকু দূরত্ব।এটি মুরগুমা পাহাড়ের একটি শীর্ষ বিন্দু;যার তিনদিকই বেষ্টিত জলাধার আর খাদ দ্বারা।শাল,সেগুন আর মহুলের পাহাড়ে হঠাৎ অতলে তলিয়ে যাওয়া খাদ।তিনদিকে জলাধার আর মাঝে মাঝে দ্বীপের মত সবুজের অবাধ চরাচর।হাওয়ার গতিবেগ এখানে তীব্র।বিশেষত বর্ষায় মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আর বিপদ সঙ্কুল হড়কা বানে যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা।তাই নামাঙ্কিত 'সুইসাইড পয়েন্ট' তকমায়।নাম করণের সঙ্গে আত্মহত্যার সরাসরি কোনও যোগ নেই।এটি আসলে দার্শনিক কল্পনা বৈ নয়!

বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট নাগাদ হোটেল ছেড়ে বেরোবার সময়েই লক্ষ্য করেছি,রিসর্ট থেকে দেড় মিনিট হাটা পথের দূরত্বে উল্টো ফুটে একটি স্থানে কিছু মানুষ _ প্রত্যেকে বিশালকায় মোরগসহ দন্ডায়মান।ফেরৎ পথে বুঝতে পারছি, লড়াইয়ের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। বিশাল প্রাঙ্গণ ঘিরে সবাই প্রতি বিপরীত দুটি দলের সেরা মোরগের লড়াই দেখতে ব্যস্ত।তাণ্ডবীয়, আসুরীক উচ্ছ্বাস মানুষের মনে!লড়াই শেষে প্রতি দলের পরাজিত মৃতপ্রায় মোরগটিকে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি জায়গায়।প্রাণীবধের এই খেলা অত্যন্ত  অমানবিক,নৃশংস_ ন্যক্কার- জনক! অথচ আজও পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে সপ্তাহান্তে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে এই নারকীয় উৎসব!

 ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে এসেছি রিসর্টে।এখন সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা। সোজা চলে এসেছি রাজহাঁস,মুরগী,নানান মজাদার দোলনা ও বৃক্ষ তলে বেদীযুক্ত ক্যাফেটেরিয়ায়। এখানে কফি ও পকোড়া গ্রহণে তৃপ্ত! চলে এসেছি আমাদের নিজস্ব স্যুইট বিভাবরীতে।পোশাক পরিবর্তনের পর ঘন্টাখানেক 'ত্রয়ী'-র আড্ডা চলছে দূর দর্শনের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে।

নীচে ডিনার চলে সাড়ে ন'টা পর্যন্ত।সাড়ে আটটা নাগাদ নেমে এসেছি।ডিনারের পর উপেক্ষিতার নিকটে অবস্থিত অ্যাকোয়াগার্ড পরিষেবার পানীয় জল ভরে নিচ্ছি কিনে জল ফুরিয়ে যাওয়া বিসলেরীর বড় দুটি বোতলে।

পরদিন প্রাতরাশ সেরে বেরুতে হবে ন'টার মধ্যে।

15- ই মার্চ,2023

বেড টি দিতে আসবার কথা ছিল। যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়ায় নিজেরাই চলে এসেছি ক্যান্টিনে। বাপটুস বেড টি খাবে না, ও চা_ ই খাবে না;শুয়ে আছে।ক্যান্টিনে এসে দেখছি,চা নিয়ে যাবার ছেলেটি আসেনি।ক্যান্টিন ভোঁ ভাঁ! রসুই ঘরে ঢুকে দেখছি দাউ দাউ করে জ্বলা কাঠের আঁচে ব্রেকফাস্টের লুচির সঙ্গে খাবার জন্য ঘুগনী প্রস্তুত হচ্ছে।আরেক পাশে ময়দা মাখা হয়ে গিয়েছে।লেচি কাটা হচ্ছে লুচির জন্য।স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে কারীগরদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কাগজের কাপে পরিবেশিত চা পান করছি এই মুহূর্তে।স্যুইট থেকে একেবারে প্রস্তুত হয়ে এসে প্রাতরাশ সেরে বেরোতে বেরোতে ন'টা কুড়ি বেজে গেল।

আজকের লক্ষ্যপথের নিশানা_

সাহেব বাঁধ

জয়চণ্ডী পাহাড় 

গড় - পঞ্চকোট 

       এবং

বরন্তী লেক।


সাহেব বাঁধ:

********* 

পলাশের আগুনে উত্তপ্ত ফাগুণে অযোধ্যা পাহাড়কে সাক্ষী রেখে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে শহরের মাঝখানে বিশাল দীঘি/হ্রদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।এটি সাহেব বাঁধ।

এখান থেকে জল সরবরাহ হয় পুরুলিয়া শহরে।সাহেব বাঁধের পাশ দিয়ে পুরুলিয়া-রাঁচি রোড ধরে চলে এসেছি জয়চণ্ডী পাহাড়ে।পথে পেয়েছি বরাকর রোডের উপরে গৌশালা।বোর্ডে লেখা জয়চণ্ডী পাহাড় / পাঞ্চেৎ/ গড়-পঞ্চ কোট /মাইথন।

জয়চণ্ডী পাহাড়:

*************

রঘুনাথপুরে জয়চণ্ডী পাহাড়। ঘড়িতে 1: 40pm। এখানে দেখব বজরঙ্গবলী মন্দির আর জয়চণ্ডী পাহাড়।সিঁড়ি ভেঙে ক্লান্ত হয়ে প্রথমে মাসীর কাছাকাছি একটি পাথরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি।বাপটুস সোজা মা চণ্ডী আর বজরংবলীর কাছে পৌঁছে গিয়েছে।ওকে বলে দিয়েছি ভাল করে ছবি তুলে আনতে।আর উঠতে না পারলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ওই দেখে নেব।না,বিশ্রামে মনের জোর বাড়তে আবার চলা শুরু করেছি।একমাত্র জীবিত দেবতা পবনপুত্র হনুমানের থানে এসে তাঁর কাছে পৌঁছাব না,তা_ও কি হয়! চলে এসেছি উপরে। জয় বজরঙ্গবলী! ফেরৎ পথে সিঁড়ি ভেঙে নামায় কষ্ট নেই। আনন্দ আছে। তবে উত্তেজনায় অথবা মাথা ঘুরে পা পিছলে পড়বার chance রয়েছে প্রতি পদে।

মাসীর কাছে পৌঁছে আগে দেওয়া কথা রাখতে পাতিলেবুর সরবৎ পান করছি তিনজনেই। এত সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময়ে মনে হচ্ছিল, এরকম ভ্রমণের স্বাদ ভ্রমণকাহিনী পড়ে মেটানোই ভাল।গতকাল পলাশ, কুলের জঙ্গল আর কাল এবং আজ 2 দিনই শাল গাছের বন দেখে উদ্বেলিত।

500টি সিঁড়ি ভেঙে মায়ের দর্শন লাভে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ  রায় পরিচালিত ' হীরক রাজার দেশে'ছায়াছবির স্যুটিং নাকি এখানেই হয়েছিল।পায়ে হেঁটে অনেকটা উঁচুতে উঠে কল্যাণেশ্বরী মন্দির।সঙ্গে পানীয় জল রাখা অত্যাবশ্যিক এখানে।

গড় - পঞ্চকোট :


************** বাড়িতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা কঠিন,কিন্তু নীচে নামা সহজ।তবে পাহাড়ে উল্টো।কারণ কাহিল শরীরে চোখ ধাঁধিয়ে পড়ে গেলে এক্কেবারে নীচে । গড়-পঞ্চকোটে দুটি ভাঙ্গামন্দির দেখছি,মেরামতি চলছে।একটি পুনর্নির্মিত;ওটি রাধাকৃষ্ণের।চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা।চারুলতা রিসর্টে লাঞ্চ সারছি।প্রথমে ভেবে ছিলাম ড্রাইভারের পরামর্শ মতোন কাকাবাবুর হোটেলেই খাব।পরে বাপটুসের নজরে পড়ল রিসর্টটি।ওর পরিকল্পনা মাফিক ওখানেই ভোজন কর্মটি সম্পন্ন হল।ওয়াচটাওয়ার থেকে অনেক কিছুর সঙ্গে দূরে ধরা পড়ছে আরেকটি ভাঙ্গা মন্দির।গড়-পঞ্চকোটের বিষয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি; সেগুলি কলকাতায় ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে বিনিময় করতে চাই। তারই যৎসামান্য এরূপ___

'গড় ' অর্থে দুর্গ, 'পঞ্চ' অর্থে পাঁচ, আর স্থানীয় ভাষায় উক্ত 'কোট'কথার অর্থ গোষ্ঠী।কথিত আছে,পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদি বাসী সর্দারের সাহায্যে এখানে রাজত্ব গড়ে তোলেন দামোদর শেখর। তিনিই পঞ্চকোটের প্রথম রাজা।তিনি এখানে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটি মন্দির নির্মাণ করান।পথে দৃষ্ট সকল কিছু লুণ্ঠন করেন তিনি।

পাঞ্চেৎ পাহাড়ের গায়ে স্থিত দুর্গটিতে এক কালে দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজাদের রাজত্ব কায়েম ছিল।আনুমানিক প্রায় 269 বছর পূর্বে মারাঠা বর্গী ভাস্কর পণ্ডিত বাংলায় প্রবেশ করেছিলেন এই পথে। আতঙ্কিত তৎকালীন বাংলার নবাব ছিলেন 1740সালে সরফরাজ খাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখলকারী আলিবর্দী খাঁ।ওড়িশার নায়েব-নাজিম তথা সরফরাজের শ্যালক রুস্তম তাকে প্রতিহত করতে চাইলে আলিবর্দী তাকে ওড়িশা হতে বিতাড়িত করেন।নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজী ভোঁসলের সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে রুস্তম ফিরে পান ওড়িশার অধিকার।আলিবর্দী পুনরায় তাকে উৎখাত করেন।

ইতিমধ্যে পাঞ্চেৎ হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে মারাঠা হানাদারীরা ভয়ানক লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে টানা বছর দশেক(প্রায়)।বাংলার জনগণের ত্রাস 'বর্গী' আসলে এই লুটেরা বাহিনীই। সেকাল হতে একাল পর্যন্ত বাংলার মায়েদের মুখে মুখে উচ্চারিত ঘুম-পাড়ানিয়া গানের কলিটি পাঠক বন্ধুদের ন্যায় আমার মনেও উঁকি দিচ্ছে__'ছেলে ঘুমাল, পাড়া জুড়াল,বর্গি এল দেশে '.....।

ভাবনা নিরসনে জানাই,1751 সালে আলিবর্দী ও মারাঠাদের  মধ্যস্থ একটি চুক্তি অবসান ঘটায় বাংলায় বর্গি হানাদারী।

স্থানীয় জনগণের নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, প্রায় দুই শতাধিক বছর পূর্বে বাঙলায় প্রবিষ্ট হয়ে বর্গিরা প্রথমেই আক্রমণ চালায় গড়-পঞ্চকোটে, ও হত্যা করে সমস্ত রক্ষীদের।প্রাসাদে ব্যাপক লুঠপাট চলাকালীন রাজার ১৭ জন রানী একটি কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।


পাহাড়ের একদিক হতে অপরদিক পর্যন্ত বিস্তৃত দুর্গের অর্ধ-বৃত্তাকার পরিখার মাঝ বরাবর দুর্গে প্রবেশের একমাত্র রাস্তা।বাকি স্থান বাঁশের দুর্ভেদ্য জঙ্গলাবৃত। পিরামিডাকৃতি  প্রবেশদ্বার হতে গোটা প্রাসাদ ও চতুর্দিক অবলোকন সম্ভব।প্রায় পাঁচ শত বর্গ কিমি পাথুরে প্রাচীরে ঘেরা রক্ষী শিবিরটি যেন দুর্গের এক ছোট্ট সংস্করণ।

কেল্লার ভিতরে দুদিকে লম্বা ও সরু দুটি ঘর দৃশ্যমান।

 3: 39pm, এবার চলেছি পাঞ্চেতের দিকে।রোড_কচবেল,3: 44pm।

অনেক খেজুর গাছ,ছোট সাইজের।একটি বিশাল স্থাপত্যকে মন্দির ভ্রম করছি। ড্রাইভার দাঁড়াল না।ওটি নাকি রিসর্ট।আবার পলাশের ছড়াছড়ি।গড়-পঞ্চকোট ইকো- রিসর্টের পাশ দিয়ে যাচ্ছি।রাস্তার দুপাশে রিসর্ট এখানে।

পাঞ্চেৎ ড্যাম: দামোদর নদের উপর অবস্থিত 1959সালে বানানো এই বাঁধটি একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট।একদিকে ধানবাদ,ঝাড়খন্ড, অন্য দিকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ তৎপরতায় সৃষ্ট এই পাঞ্চেৎ ড্যাম।


কাছেই আরেকটি বাঁধ,' টোটকা ড্যাম '। টলটলে জলরাশি, সবুজে ঘেরা জঙ্গল, _ 2কিমি পরেই ঝাড়খন্ড। পদব্রজে চলে যাওয়া যেতেই পারে __না, কোনারকে নয়,পুরুলিয়ার সূর্য্যমন্দিরে!


কিশোর,তরুণ ও প্রায় প্রৌঢ়ের একটি পুরুষ দলকে শিবরাত্রির চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছি।ঘড়িতে 4: 23pm।শর্বরী গ্রামে প্রবেশ আমাদের। মিনিট দুয়েকের মাথায় চলে এসেছি শর্বরী মোড়, বরা করে।এবার আমাদের যাত্রার অভিমুখ বরন্তীর দিকে।পথে রাধাকৃষ্ণের সুন্দর বড়মন্দির। চুরিপাটনা। রামপুর,4: 44pm।

বরন্তী লেক:

**********

পাহাড়,জঙ্গল আর নদীর মাঝে পুরুলিয়ার স্বপ্নরাজ্য এক ছোট্ট গ্রাম,বরন্তী।রঘুনাথপুর মহকুমার বরন্তী হ্রদের পাশে থাকেন কয়েক ঘর আদিবাসী।নিরিবিলি এই গ্রামটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে একটি ক্রমবিখ্যাত ভ্রমণকেন্দ্রের ঠিকানা।এটি আসানসোল শহরের কাছেই।দূরত্ব মাত্র 38 কিমি।চারদিকে গরঙ্গী,পাঞ্চেৎ (পঞ্চ কোট) এবং বিহারীনাথ পাহাড়।বরন্তী নদী বয়ে চলেছে মুরাডি পাহাড়ের গা ঘেঁষে। রুক্ষ-শুষ্ক জায়গাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সমভূমির থেকে আলাদা।হাতছানি দিচ্ছে পাহাড়,নদী,জঙ্গল।এটি সূর্যাস্তের সময়;হ্রদ হয়ে উঠেছে মোহময়!বরন্তী নদীতে রামচন্দ্রপুর মিডিয়াম ইরিগেশান প্রজেক্টের জন্য এই হ্রদ গড়ে উঠেছে জলাধার হিসেবে।আশপাশে রয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণ_ মাত্র 12  কিমি দূরে আমাদের দর্শীত গড়-পঞ্চকোট, 21 কিমি দূরে ফেলে আসা জয়চণ্ডী পাহাড়, যেখানে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ' হীরক রাজার দেশে '- র স্যুটিং হয়েছিল।দুটি স্থানই আমরা ঘুরে পেরিয়ে এসেছি।আরও আছে, 18 কিমি দূরত্বে ' বাংলার আরাকু উপত্যকা ' বলে পরিচিত বিহারীনাথ।

গভীর জঙ্গলের মধ্যে কয়েকদিন থাকবার মতোন আশ্রয় মিলতে পারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বরন্তী ইকোট্যুরিজম রিসর্টে।চতুর্দিকে শাল,পিয়াল,মহুয়া,সেগুন গাছের সমারোহ।শীতের মরসুমের শেষাশেষি না বলে বলতে পারি,বসন্ত উঁকি দিচ্ছে!তাই অন্য বছরের ন্যায়ই হ্রদে ভিড় জমিয়েছে অসংখ্য পাখি। জংলী খরগোস আর শূকর দেখতে পাচ্ছি;হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের আশে পাশে।এমন পরিবেশে দারুণ জমে পিকনিক,তা 'ত্রয়ী'-র বাপটুসই ভাল বলতে পারে।ওরা বন্ধুরা মিলে এখানে পিকনিক করতে এসেছিল হপ্তাখানেক আগেই।রাঢ় অঞ্চলে বেড়ানোর ইচ্ছে হলে বরন্তী আদর্শ জায়গা!

ভ্রমণের সঙ্গে রয়েছে পাহাড়ে চড়বার সুযোগ।

নদীর ধার বরাবর ড্রাইভ করে চলে যাওয়া যায় পাঞ্চেৎ কিম্বা মাইথন বাঁধে।এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি,কলকাতা হতে আগত একটি কনভয় __ বাঁধ পর্যবেক্ষণে দপ্তর থেকে আগত কতিপয় বাস্তুবিদের একটি দল। যাই হোক, রঘুনাথপুরে গিয়ে দেখে আসা যায় তসর শাড়ীর বিচিত্র সম্ভার।আরও অ্যাডভেঞ্চার চাইলে বরন্তী পাহাড়ের উপরে উঠতে পারা যায়।সঙ্গে একজন স্থানীয় গাইড নিতে পারলে ভাল হয়।আমাদের সঙ্গে উত্তম রয়েছে।তাই পৃথক গাইড লাগছে না।পাহাড়ের মাথা থেকে গোটা অঞ্চলের দারুণ ভিউ প্রাপ্তি সম্ভব।চোখে পড়ছে বাঁধের অপরূপ দৃশ্য আর সেই সঙ্গে মায়াবী প্রকৃতির সুষমা।

এবার আমার প্রিয়,আদুরে রাঙ্গা পাথুরেডাঙায় আমাদের সাময়িক বাসস্থানে প্রত্যাবর্তনে উদ্যত হয়েছি আমরা।শহরটি ঘিঞ্জি এবং উন্নত। পি সি চন্দ্র অ্যান্ড সন্স এবং প্যান্টালুন্সের ন্যায় শপিং মলই জানান দিচ্ছে এর উন্নয়নকামী প্রবণতার কথা।

বরন্তী ভ্রমণের সর্বাপেক্ষা সঠিক সময় শীতকাল, মানে এই অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি। অন্যদিকে বর্ষাকাল বা জুলাই - সেপ্টেম্বরে বরন্তীর আরেক রূপ।হ্রদ তখন কানায় কানায় পূর্ণ। মার্চ - জুন অর্থাৎ গ্রীষ্মকালেও আসা যায়। তবে মাথায় রাখতে হবে পুরুলিয়ার গরম এবং শুকনো আবহাওয়ার কথা। 


জঙ্গলে রাত কাটাতে পারা যায় মন চাইলে।আর তা না চাইলে বড়ন্তী থেকে সড়ক পথে মাত্র 90 মিনিটের দূরত্বে স্থিত পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের নিজস্ব শৈল্পিক ট্যুরিজম প্রপার্টিতে অর্থাৎ পূর্বতন 'পথিক মোটেল '- এ কয়েকদিন থাকা যায় স্বচ্ছন্দ্যে।


মুরাডি গ্রাম।

গাংপুর গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছি।একটি স্টেশন। গাংপুর, মুরাডিই চলছে।একটি গ্রাম্যমন্দিরের পাশ দিয়ে চলেছি।সে-ই পলাশ আর আকন্দ। সামনে স্কুল।5: 23পিএম

চারপাশে মাঠ আর পাহাড়;সঙ্গে জঙ্গল। ইনান পুর,ভস্কো,রামচন্দ্রপুর,রেললাইন,বুদ্ধপার্ক,গোবাগ,নেটুরিয়া ব্রিজ,ঝাড়ুখামার,নতুন ডি অতিক্রম করছি একে একে।

এখানে ওভারব্রিজ নির্মাণ চলছে।সংকীর্ণ সেতু।5: 53pm। সে-ই বরাকর রোড _ রঘুনাথপুর, (বরাকর ) চলছে।5: 57পিএম; জায়গাটি জমজমাট।স্টেশন,শাখা,সূর্যমন্দির,হরিপদ সাহিত্য মন্দির (পাঠাগার) অতিক্রম করছি একে একে।চোখে পড়ছে রেডক্রস রোড, পুরুলিয়া 7: 06 pm, মিউনিসিপ্যালিটির পরেই সেন্ট পিটার্স স্কুল, বি টি রোড, পুরুলিয়া পড়ল। লেখা রয়েছে বিটি সরকার রোড, পুরুলিয়া 7: 10pm; দেখতে পাচ্ছি,লেবার ডিপার্টমেন্ট,WB govt.7:11 pm, এরপর পুরুলিয়া শিক্ষা নিকেতন,পুরুলিয়া প্রাই মারী স্কুল,চাকোলটার অতিক্রান্ত।

পথে এক জায়গায় চা পান হচ্ছে।তারপরে   আরও ঘণ্টাখানেক ছুটে চলেছে আমাদের রথ(গাড়ি)। কিন্তু আলো কম থাকায় রাস্তায় লেখা নাম ধাম আর তেমন স্পষ্টভাবে পড়তে পারছি না। অবশেষে আমাদের রিসর্ট।নীচে ক্যাফেটেরিয়া পার্কটির আগে ডানদিকে হস্তশিল্প বিপণন কেন্দ্র।স্বনির্ভর মহিলাদের দ্বারা প্রস্তুত জামাকাপড়,গামছা,তোয়ালে,শীতবস্ত্র ও ঘর সাজাবার পুতুল,ফুলদানী,গয়নার বাক্স থেকে শুরু করে নানান দ্রব্য ও ঘি, মধু ইত্যাদিরও সম্ভার।এক দর।ওখান থেকে একটি গামছা কেনবার ইচ্ছে ছিল, পছন্দ হল না।মশলার কয়েকটি প্যাকেট নিয়ে নিচ্ছি স্মারক হিসেবে।


তৃতীয় দিন 

( 16. 03. 2023 ) 

এদিনের ভ্রমণ তালিকায় রয়েছে স্থানীয় দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ।

আজও বেড টি-এর অপেক্ষা না করে নীচে নেমে এসে কারীগরদের নিকটে চায়ের আবদার জানি য়েছি।আমি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছি কাঁচের কাপে চা পেলে বেশ হত।ক্যান্টিনে বসে আছি।সহসা সুন্দর কাপে চা নিয়ে এসে চমকে দিল রাজু নামের এক কর্মী।

চা-বিস্কুট পর্ব সমাধার পর উপরে উঠে ফ্রেশ হয়ে একে বারে প্রাতঃরাশ-এর জন্য নেমে এসেছি নটার মধ্যে।আজ ওদের দপ্তরী ব্যবস্থাপনায় আমাদের এই ঘরটি ছেড়ে দেওয়ার কথা।তার পরিবর্তে ক্যান্টিনের খুব কাছাকাছি ' মালবিকা ' রিসর্টে স্থান-সংকুলান হবে__ আমাদের নয়, মালপত্রের!কারণ আমরা স্থানীয় জায়গা দর্শন সেরে বারোটার মধ্যে ফিরে লাঞ্চ করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যাব।তাই প্রাতরাশের পর দপ্তরে বিভাবরী রিসর্টের চাবির গোছা জমা দিয়ে যাচ্ছি।ওঁরা বিভাবরী থেকে মালপত্র নিয়ে সময় মত মালবিকায় পৌঁছে দেবে ।


রিসর্টে ফিরে মধ্যাহ্নভোজনটি একটুখানি আগে সেরে12:30 নাগাদ বেরিয়ে পড়েছি।এদিন হুক মুলা মাঠে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় - এর সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, উত্তমের মুখে শুনলাম। আপার ড্যাম থেকে যাবার পথে মাটির নিচে 5তলা সমান বিল্ডিংয়ের সন্ধান পেলাম।


পথে ' ভারত সেবাশ্রম সংঘ ' দেখে খুব প্রীত হচ্ছি।কারণ আমার জীবনে প্রথম বাইরে কোথাও গিয়ে থেকেছি এই প্রতিষ্ঠানেরই তারাপীঠ কেন্দ্রে _ পিতা গত হওয়ার বছরেই।এক বছর পূর্তি না হওয়ায় সেবার আমি আর মা মন্দিরে পুজো দিইনি।মানসিক পরিবর্তন ঘটাবার জন্য দাদাবৌদি আমাদের নিয়ে যান।অপ্রাসঙ্গিক হলেও মনে পড়ছে,মা মন্দিরের  বাইরে একটি ছায়াময় সুন্দর স্থানে বসেছিলেন।মায়ের কাছে শোনা,' তাপস আর পাপিয়া আমার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলল।ফটোও তুলেছে।' আমি অবশ্য আশ্রমের ঘরেই ছিলাম।তাপস পাল আমাদের মধ্যে আর নেই।তবে পাপিয়া অধিকারীর মনে থাকলেও থাকতে পারে 1991 সালের এই ঘটনাটি!


ময়ূর পাহাড় দেখবার কথা ছিল।ওটা কি দেখা হয়নি!আসলে ধূ ধূ প্রান্তরে সবই পাহাড়, আর শাল-পলাশ,আর পাথুরে ডাঙা! আলাদা করে জায়গা বোঝবার অনুভূতি বোধ হতে চাইছে না!তুর্গা ফলসও বাকি আছে।

মাঝি ভি,(বাগমুণ্ডী,পুরুলিয়া) ক্রস করছি।

মার্বেল লেক যেতে দুধারে ঘন জঙ্গল। ড্রাইভার উত্তম মোবাইল, কম্পিউটারের উপরে পড়াশোনা করেছে অনেক। স্কোপ নেই; তাই ড্রাইভিং-এ আসা,সঙ্গে পাথুরে ডাঙ্গার পর্যটকদের জন্য গাইডের কাজটিও রয়েছে। 

বাগমুন্ডি পুলিশ স্টেশন.

Water supply.

এসে গেল বহু প্রতীক্ষিত বামনী ফলস!

বামনী ফলস: নামতে মজা, ওঠার সময়ে মনে হচ্ছে প্রাণ যায় যায়! তাই শরীরের তাকত বুঝে নামা উচিৎ __ ' ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না।' একদম নীচে নেমে যদি কোনও জংলী প্রাণীর সামনেও পড়ি তো ওখানেই নিজেকে উৎসর্গ করা ছাড়া গতি থাকবে না। উঠে সমতলে আসতেই পারব না আর। তাছাড়া এমনিতেও অজানা,অচেনা,নির্বান্ধব এলাকায় নেমে উঠতে না পারলে ' ত্রয়ী '- র বাকি দুই সদস্যের অবস্থা হবে সমস্যাগ্রস্ত! তাই পুরো না নেমে, কিছুদূর নামবার পরেই একটি বাকাচোরা , এবড়ো- খেবড়ো পাথরের উপরে বসে রয়েছি। বাকি দুজনের অনুভূতি বিনিময় করব পাঠক বন্ধুদের সাথে।

এরপর চরিদা।

টাটা 85 ধরে এখান থেকে সোজা জামশেদপুরে চলে যাওয়া যায়।

গো সাই ডি জোর 10: 42 am.

বাগমুন্ডি পলিটেকনিক।

বাগমুন্ডিতে ঢুকছি।

CRPF (আর্মি)

স্কুল,সেকেন্ডারি স্কুল।

বাগমুন্ডি পাহাড়ে  উত্তমের পছন্দসই সেরা দোকানে চা পান হচ্ছে। ভাবরা খাচ্ছি চায়ের সাথে বাগমুন্ডিতে। স্বাদে আমাদের ফুলুড়ির মত,আর দেখে মনে হচ্ছে জিলিপি খাচ্ছি।10: 57am; অন্যান্য আরও কিছু মিষ্টি গ্রহণ করছি এখানে। আনন্দনগর ক্রস করছি,11: 15am।


চরিদা:

চরিদার শুরু থেকেই প্রাণে মাখছি আদুরে রাঙ্গা পলাশের আগুনে মিঠে অভিনন্দন।

মুখোশ গ্রাম। 'ছৌ -এর মুখোশ তৈরির আঁতুড়ঘর চরিদা ', কথাটি গ্রাম্য শিল্প-সাংস্কৃতিক  জগতের বাসিন্দাদের মুখের  বুলি এখন।বাংলার নিজস্ব নৃত্য-শিল্প ' ছৌ '।তা আজ আর শুধুমাত্র বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। ছৌ নাচের পোশাক থেকে মুখোশ _ এই বিশাল কর্ম-যজ্ঞের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা কেমন আছেন কিম্বা কেমন ছিলেন কঠিন মহামারী কালে! এই মুহুর্তে সেই মুখোশ গ্রামের পরিস্থিতি কিরূপ, সেটি আমার ন্যায় সকল পাঠকবন্ধুকেই ভাবাচ্ছে, আশা করি!


2020সালে ছৌ-নাচের মত বিষয় যখন অসংখ্য গবেষকদের গবেষণার বিষয়,প্রত্যেকের কাজের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে অভিনব সব তথ্য,তখন সব চাইতে নজর কাড়ে ছৌ-নাচের শিল্পীদের নিদারুণ অর্থকষ্টজনিত ভোগান্তির রেখাচিত্রটি!



মুখোশ তৈরি করা হয় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে।ছৌ-নাচের পালায় উঠে আসে মহিষাসুরমর্দিনী,রামায়ণ,মহাভারত এমন-কি  শিব-পার্বতীর কাহিনীও। কখনও এই নৃত্য-প্রকরণের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় দেবতা দের নিছক দেবতারূপে না দেখিয়ে তাঁদের মনুষ্যরূপ।বিভিন্ন পৌরাণিক দেবদেবী ছাড়াও বর্তমান ছৌ-এর মধ্যে মিশে গিয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ধ্রুপদী নৃত্যশৈলী;যেমন কথাকলি, মণিপুরী, ওড়িশি, কুচিপুরীর ন্যায় নাচের মুখোশও এখন নির্মাণ করছেন শিল্পীরা।কথা প্রসঙ্গে বলি,পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া ছাড়াও ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশায় ছৌ বিখ্যাত। তবে পূর্ব - ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিল্প হওয়া সত্ত্বেও নৃত্যে মুখের অভিব্যক্তি প্রদর্শনের তাগিদে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে মুখোশ ব্যবহৃত হয় না। মুখোশের জন্য বিশিষ্টতা অর্জনকারী কেবল পুরুলিয়া ওরফে আমার পাথুরেডাঙা।

মুখোশ গ্রামে অনেকক্ষণ কাটাচ্ছি।

অযোধ্যার কোলে সহজ শান্ত একটি গ্রাম চরিদা।গ্রামে প্রবেশের মুখেই দৃষ্ট রাস্তার দু' ধারে সারি সারি অসংখ্য মুখোশের দোকান।কেউ মুখোশে সবে রঙ দিচ্ছেন, কেউ চোখ আঁকছেন,বছর আষ্টেকের ছেলেটিও সাজ বসাচ্ছে মুখোশের।তাদের এই ব্যবসা বংশ-পরম্পরায় প্রবাহিত।বর্তমানে মুখোশ শুধুমাত্র নাচেই ব্যবহৃত হয় না।দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ঘর আলো করা ড্রয়িংরুমে শোভা পাচ্ছে চরিদার মুখোশ।একদা এলাকাটিতে ভাঁটা পড়েছিল উক্ত ব্যবসায়ে।শুধুমাত্র লোকশিল্প হিসেবেই জনপ্রিয় ছিল তা।ছৌ-নাচ হয়ে উঠেছিল এই বিশ্বে একটি ফ্যান্টাসির জায়গা।

শীতের মরসুমে অঞ্চলটিতে এসে ভিড় জমান দেশ-বিদেশ হতে আগত পর্যটকের দল।নভেম্বর,ডিসেম্বর এবং জানু য়ারি _ এই তিনটি মাস রোজগারের জন্য আকুলতা তাই, ছৌ-শিল্পীদের।আমরা ছৌ-নাচের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব দিই ছৌ-নৃত্য শিল্পীদের।কিন্তু বিস্মৃত হই এই বিশাল কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত মুখোশ ও পোশাক ,ইত্যাদি গড়ার কারিগরী শিল্পীদের। এখনও যাদের ঘরে গেলে দেখতে পাই _ এই মুহূর্তে কয়েকটি ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে দেখতেই পাচ্ছি,সরু একফালি বিছানা আর কয়েকটি ঘটি বাটি ব্যতীত আর বিশেষ কিচ্ছুটি নেই।আছে শুধু নানান রকমের অগুনতি মুখোশ।তারা কি উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছেন!এই বিস্মৃত ইতিহাসের সঙ্গী __কুশীলব, যে তারাও!

চরম অর্থ-সংকটের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন এখানকার বিখ্যাত শিল্পীরা।পরিস্থিতির বদল এল বর্তমান রাজ্য সরকার গৃহীত সিদ্ধান্তে।ছৌ-শিল্পীদের ভাতার ব্যবস্থা করেছে সরকার_'প্রতি মাসে এক হাজার টাকা'। ফলতঃ ছৌ-এর দল বৃদ্ধিপ্রাপ্ত।আর উপরি পাওনা,লোক-শিল্পীদের তরফে ' আন্তর্জাতিক ' তকমা প্রাপ্তির ন্যায় সম্মানজনক স্বীকৃতি!

প্রায় শতাধিক পরিবার তৈরি করছেন ছৌ-নাচের মুখোশ।শিল্পীর সংখ্যা প্রায় চার শতের উপরে। সূত্রধর সমিতির 'ছৌ-মুখোশ শিল্পীসঙ্ঘ'2012 সাল থেকে বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে মুখোশ তৈরির কাজে ব্যস্ত। এখানকার দোকানে বসে দেখতে পাচ্ছি,ছৌ-নাচ এখন আর শুধুমাত্র মহিষাসুর মর্দিনী পালাতেই সীমাবদ্ধ নেই; গণেশ, কার্তিক, ময়ূর, রাক্ষস-খোক্কস,কালী,সীতা,রাবণ_কত রকমের মুখোশই না আছে এই দোকানে। অধুনা এখানে প্রাপ্তি সম্ভব আদিবাসীদের প্রচলিত নানা কাহিনীর সঙ্গে জড়িত মুখোশও।

চরিদার এই অখ্যাত শিল্পীদের ভোলা কি যায়!কুশলপল্লী ক্রস করছি। ঘড়িতে 11: 58am।

তুর্গা ড্যাম:

11: 59am

এখানে শিব-মূর্তিটি বাঁশ চেরাই করে বানানো।রামলক্ষ্মণ ও সীতারও মন্দির রয়েছে।হনুমানজীর আলাদা মন্দির চোখে পড়ল না।মন্দিরের বাইরে থেকে সেই পছন্দসই গামছাটি কিনে নিচ্ছি।

তুর্গা ফলস অভিমুখে চলেছি।

তুর্গা ফলস:

এবড়ো - খেবড়ো সিঁড়ি এখানে। এক্কেবারে unplanned বলা যায়। অল্পবয়সে নামবার চেষ্টা করা যেত। দু'পা এগিয়ে পিছিয়ে এলাম।এখানেও বাকি দুই ছোট ও বড় সদস্যের মুখ শ্রুত অভিজ্ঞতার কথা জ্ঞাত করব বন্ধুদেরকে, পরে।

পড়ে রইল লোয়ার ড্যাম আর আপার ড্যাম। লোয়ার ড্যাম ছেড়ে আপার ড্যাম অভিমুখে চলেছি। গুটিকয় পথ-দোকানী জ্বালানী কাঠ জড়ো করে বিক্রি করছেন।এটি বিশাল জীবিকা এখানকার।

আপার ড্যাম-এর পর রয়েছে সীতাকুন্ড।ওটি দেখব না সময়ের অভাবে।তবে ওটির মাহাত্ম্য জেনে নিয়েছি।

সীতা কুণ্ড:

জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিখ্যাত আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম ছাড়িয়ে ' ময়ূর পাহাড় ', 'কুমীর হা গুহা ' অতিক্রম করে চরিদার অদূরে রয়েছে সীতা কুণ্ড। কথিত আছে, রামচন্দ্র অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন পথভ্রান্ত হয়ে এখানে কিয়ৎকাল বিশ্রাম গ্রহণ করেন।তখন সীতা তৃষ্ণার্ত হলে রামচন্দ্র পাতালভেদী বাণ নিক্ষেপ করতেই মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে তৃষ্ণা নিবারণার্থক পানীয় জলের ফোয়ারা।তাই অদ্যাবধি এই জলকুণ্ড __আদিবাসীদের নিকট ' সীতা কুণ্ড ' নামে অতীব পবিত্ররূপে মান্যতা প্রাপ্ত।

অনুরোধ রইল,' পর্যটক বন্ধুরা কুণ্ডটি দেখে এসে লিখে জানাবেন,মনে করে।' সংরক্ষিত এলাকা গুলিতে প্রবেশ নিষেধ। 

নজরে পড়ছে একটি গুহা_ টার্বাইন অঞ্চলের প্রবেশপথ এটি ।অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করা চলবেনা।এর নিচে প্রায় 5তলা নির্মাণ ( পূর্বে উল্লিখিত )আছে__ওরেব্বাস! উত্তম শিক্ষিত ছেলে;ও এই বিষয়টি সুন্দর বুঝিয়ে বলছে।

আপার ড্যাম মানে আমরা অযোধ্যা হিলটপের দিকে আগুয়ান।

আপার ড্যাম:

***********

এখান থেকে দূরে পাহাড়ের রেঞ্জগুলি এত সুন্দর লাগছে,যা অবর্ণনীয়! উসুল ডুংরি এখান থেকে চল্লিশ মিনিট দূরত্বে স্থিত।

এরপর অযোধ্যা হিল টপ।

মাঝেমধ্যেই ট্যুরিস্ট হেল্প-ডেস্ক চোখে পড়েছে।এই মুহূর্তে তেমন একটি কেন্দ্র ক্রস করছি।কালকে দেখা এমন একটি ডেস্কের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছিলাম।এটি সেটি নয়,সবাই বলল।আমার অবশ্য সল্টলেকের রাস্তায় কলকাতার ন্যায়  ঠিকানা লেখা থাকতো না বলে এক সময়ে রাস্তা গুলিয়ে যেত। যদিও এখনও তথৈবচ।

একটি মোরগের ডাক আর সেই সঙ্গে অবাক করা গাঁদাফুলের ঝাঁক চমক জাগালো মনে।এ ক'দিন এহেন ধ্বনি ও দৃশ্য-এর মুখোমুখি হইনি একবারের জন্যেও।

এবারে বামনী ফলস।এটি চলতি পথে পূর্বেই দর্শিত। সময় যন্ত্রে 12: 45pm.। আরও চার কিমি দূরে আমাদের রিসর্ট।এই মুহূর্তে সাহেবডি-তে।পলাশবাড়ী রেস্তোরাঁর কাছে ড্রাইভার বদল হচ্ছে গাড়ির মালিকের ব্যবস্থাপনায়।

অযোধ্যা হিল-টপের 'মহল হোম স্টে '।ড্রাইভারের কাছে জানতে পারছি,সরকার থেকে খুব কম সুদে লোন দিচ্ছে; তাই পাহাড়ের দিকে কিছু দুর অন্তর 'হোম স্টে' গড়ে উঠছে। 

রাম-সীতার বনবাস কুটির।12: 57pm বেজে গিয়েছে;তাই, নামলাম না আর।হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। বোর্ডে লেখা ' আর্ষা ', সিরকাবাদ,তামনা, পুরুলিয়া।

https://photos.google.com/photo/AF1QipOKO9tHk02trE_P6-xXqXPd3TGP_5DrnPKZswms

গাড়িতে বসেই দেখতে পাচ্ছি,বাউরীদের মাটির দেওয়ালে বিশাল ফাটল ধরেছে।মাটির বাড়ির দেওয়ালের বাইরে সুন্দর আলপনা আঁকা।এই আদি ও শৈল্পিক সৌন্দর্য্য শহুরে কৃত্রিমতাকে হার মানায়!

শিলিংদা ফোর্ড।2:06pm সীরকাবাদ, বেগুন বেকার _ ডাইনে খাদ,বাঁয়ে পাহাড়। ভিউপয়েন্টে নেমে ফটো তুলছি।যে পথ ধরে প্রথম দিন এসেছিলাম_ সেতু,ছবির মতন আঁকা,_ সে পথ ধরেই ষ্টেশনে পৌঁছাবার পথে চলেছি।চোখে পড়ছে আদুরেরাঙা পাথুরেডাঙ্গার সাধারণ চলার পথগুলি_ বান্দু সেতু,কোলাবনি মোড়, দু'পাশে ফাঁকা মাঠ,...।

মাটির বাড়ির রাস্তার দিকের দেওয়ালে জানালা নেই।গাড়ির ধোঁয়া থেকে বাঁচতে কি না কে জানে! 

লছমণপুর... এখানকার ' মাটির সৃষ্টি প্রকল্প '.. নামলাম না।কুলটার অতিক্রম করছি। কোনও না কোনও অভিমান থেকে সৃষ্টি হয়েছে একেকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঞ্চলের নাম। বিশ্ব জুড়ে সে রহস্য উদঘাটন সহজ সাধ্য নয়।

হাড়নামা; পুরুলিয়া মানবাজার;...

' জনবহুল এলাকা/ গাড়ি আস্তে চালান ' লেখা, অথচ জায়গার নাম মনে করে পড়তে গিয়ে 'এপ্রিল ফুল' বনছি মার্চের মাঝামাঝিতে।এল বলরামপুর,পাররামা 2:40pm।

হালকা বেগুনী রঙের ফুলগুলি কলকাতার মফস্বলে_আসলে আমাদের নিমতের বাড়ির বাগানের জঙ্গলে অজস্র ফুটতে দেখেছি।এখন চলেছি বড়ঠেকরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে।পার হচ্ছি নদী আর ব্রিজ একই সাথে। দামদা,.. 'আজ পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসছেন পাথুরেডাঙায়;' চালক জানালেন পুনরায়। লেখা আছে Go slow/ Work in progress ...রাঁচি,বোকারো যাবার রাস্তা।দুর্গা মন্দির, ফেতিকা,কুইরি পাড়া, পুরুলিয়া....।

ওখানকার চলতি উচ্চারণে চালক জানালেন যে জয়নগর হুকমূলায় সাড়ে বারোটায় দিদির মিটিং ছিল। হুকমূলা শব্দটি অনেকবার ওনার কাছে শুনতে চেয়ে লিখে রেখে ছিলাম। ভূল হলে মাফ করবেন, বন্ধুরা।এসে গেল আনারা, আদ্রা..।Train: রূপসী বাংলা Time: 4: 17pm.

ষ্টেশন গুলি: ছাতনা,বাঁকুড়া,বিষ্ণুপুর,গড়বেতা,চন্দ্রকোনা রোড,শালবনি,মেদিনীপুর,খড়গপুর,সাঁতরাগাছি,হাওড়া। ত্রয়ীর অধিনায়ক বাঁকুড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে অবতরণ করায় বাকি দুজনের মন হু হু করে উঠল।

পুরুলিয়া জেলার বলরামপুরের গালা শিল্প বিখ্যাত। 17 - ই মার্চ জী বাংলায় দিদি নং 1 অনুষ্ঠানে এক দিদি একটি ওই স্থানীয় আংটি আর তার স্বামীর হাতে আঁকা সঞ্চালিকা শ্রীমতি রচনা ব্যানার্জীর ছবি উপহার দিলেন রচনাদির হাতে। ইস আগে জানলে ওই বলরামপুর অঞ্চলেও ঘুরে আসতাম। যাই হোক, এখনও ঘরে ফিরিনি কাহিনীতে।11pm নাগাদ বাড়ি ফেরার পথে রুটি ও তড়কা পেলাম।তরকাটি ঝালে পরিপূর্ণ। টকটক ভ্রমণের ক্লান্তিতে ঝাঁঝাল নৈশভোজনের পর মিষ্টি একফালি নিদ্রা শরীর ,মনে এঁকে দিল স্বপ্ন _ জানা,অজানা আর আস্বাদিত ও অনাস্বাদিত অংশের কাহিনীতে ভরপুর!

ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে সব তথ্য ডায়েরীতে সংযুক্তি হয়ে ওঠে নি। পরে চিন্তা,ভাবনা ও অনুসন্ধানের ফসলটি পরবর্তীতে লিপিবদ্ধ হয় সেখানে। রাকাবের জঙ্গল,খয়রাবেড়া ড্যাম, পিঠিদিরি ঝর্ণা, তালাজুড়ি শিবমন্দির,ডহরী খাল ও ঝর্ণা, কুকুর জবরা খাল, দেওলঘাটা মন্দির প্রভৃতি অফবিট ভ্রমণ বিন্দুগুলি কত না নরনারীর হৃদয় কাড়ে, তা বলাই বাহুল্য!

রাকাবের জঙ্গল:

 পুরুলিয়া শহর থেকে বেরিয়ে কেশর গড় যাবার রাস্তায় পড়ে ' রাকাব '।মূল রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের শুষ্ক কাঁকরময় কাঁচা রাস্তার দু'পাশের গাছে একান্তে মনের কথা বিনিময় করতে দেখা যায় ঘুঘু আর হলুদ পাখিদের __ জোড়ায় জোড়ায়। ফিঙে,টসরাজা,শিমফুচি, বনচটি, ঝুরাবনি আর বিপন্ন অথবা বিলুপ্ত প্রায় পাখিদের সমাগম এখানে।

শাল,পিয়াল বহেরাসহ নানান জানা অজানা দেশীয় গাছ-গাছালির সমাবেশ শহুরে জীবনে অভ্যস্ত পর্যটকের নিকট  তুলে ধরেছে বিভূতি ভূষণের আরণ্যকের খন্ড দৃশ্য!

1857সালের 5- ই আগস্ট কেশরগরের মহারাজা গরুড় নারায়ণ সিংহের বীর পুত্র নীলমণি সিংহের নেতৃত্বে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল কৃষক রাকাব জঙ্গলে সমবেত হয়ে বৃটিশ রাজত্বকে উৎখাত করবার শপথ নেন।

জঙ্গলের অসীম নির্জনতার ধ্রুব সাক্ষী কাঁসাই নদী। জঙ্গলের বনদেবী বা রাকাব বুড়িকে সাক্ষী রেখে ইংরেজদের বিতারনের সাঁওতালী মন্ত্রটি ছিল ,' ইংরেজ দ বন রাকাব কো আ ' পুরুলিয়া ট্রেজারি থেকে লক্ষাধিক টাকা লুঠ ,প্রায় 300 বন্দীকে কারাগার হতে মুক্তকরণ ও সরকারি ভবনের আসবাবপত্র ও দলিল দস্তাবেজ ভস্মীভূত করে ঐ বাহিনী।ঐ আদিবাসীদের বংশধরেরা আজও জীবিত কেশরগড়ে।

ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় প্রথম অযোধ্যা পাহাড়কে কেন্দ্র করে একটি ট্যুরিস্টস্পট করবার পরিকল্পনা নিলেও তা বাস্তবায়িত  হয়নি। পরে সবুজে ঘেরা ছোটনাগপুর মালভূমির অংশবিশেষ__অযোধ্যা পাহাড় হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। একদিকে বাগমুন্ডি,অপরদিকে সিরকাবাদ __ দু'দিক দিয়েই ওঠা যায় পাহাড়ে।পাহারজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে শাল, মহুয়া, শিরীষ,সেগুন,পলাশ ও অন্যান্য অজস্র গাছ। পাহাড়ে উঠতে গেলে নেমে আসে একাধিক ঝর্ণা।পাহাড়টির উচ্চতম শৃঙ্গ সেই ভূগোল বইতে পড়া গোর্গাবুরু (2,850 ফুট)। প্রায় 34,517 একর পাহাড়ী এই অরণ্যে রাতের দিকে পর্যটকের রোমাঞ্চ _ ভালুক, বুনো শূকর,নেকড়ে, হায়না, বাঁদর ও মাঝেমধ্যে দলমা হতে নেমে আসা বুনো হাতির দল।


পাঞ্চেৎ ড্যাম**

দামোদর নদের উপর অবস্থিত 1959সালে বানানো এই বাঁধটি একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট।একদিকে ধানবাদ , ঝাড়খন্ড অন্যদিকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ তৎপরতায় সৃষ্ট এই পাঞ্চেৎ ড্যাম।

কাছেই আরেকটি বাঁধ__ টোটকা ড্যাম। টলটলে জলরাশি, সবুজে ঘেরা জঙ্গল; 2 কিমি পরেই ঝাড়খন্ড। পদব্রজে চলে যাওয়া যেতেই পারে __না,কোনারকে নয়, পুরুলিয়ার সূর্যমন্দিরে!


খয়রা বেড়া ড্যাম:

পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্তের প্রতিফলন জলের উপরে __ ভারী সুন্দর, দৃষ্টি- নন্দন!


পিঠিদিরি ঝর্ণা:

অজানা - অচেনা পিঠিদিরি ঝর্নার কথা বলি।ঝর্নার উপরোস্থ শিবমন্দিরটিতে গ্রামের মানুষ পুজো দেন নিয়ম করে।স্যুইমিংপুলের মজা আহরণে অনেকে আসেন এখানে।তবে পাকা রাস্তা হলে সাধারণ পর্যটকেরা ভিড় জমাবেন, আশা রাখি।

সাহাবজোড় নদীটি মুরুগুমাতে মিলিত হয়ে কংসাবতী নদীতে মিশেছে।

শিবলিঙ্গটি স্বপ্নাদেশ মাফিক 40বছর আগে কাশি থেকে এনে এখানে স্থাপন করেন দুর্গাচরণ সিং মুড়া।

ঘ্যাঘাশ্বরী ফলসও রয়েছে এখানে।

গোর্গাবুরু আর চেমটাবুরু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ঝরনা বেষ্টিত দুর্গামন্দিরটি ছোট্ট ঘরে প্রস্তর  দ্বারা নির্মাণ করেন মহাদেব বেরা।মন্দিরটি 20 বছরের পুরনো। আমগাড়া ঝর্ণাটিও অদূর ভবিষ্যতে দ্রষ্টব্য জায়গা দখল করবেই। সবথেকে বড় কথা বহুমূল্য চন্দন গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দুর্গামন্দিরের আশেপাশে।

বিশ্ব বিজয়েশ্বর মহারাজ, সিদ্ধপীঠ, তপোবন, মহাদেব বেরা নামগুলি লোককাহিনীসূত্রে গাঁথা।জৈন নাগ রাজেশ্বর __ স্বয়ং শিববাবা প্রকট হয়েছেন এখানে।


তালাজুড়ি শিবমন্দির:

পুরুলিয়া জেলার কাশীপুরের অদূরে তালাজুড়ি শিব মন্দির।মূলমন্দিরে বরুণেশ্বর (বর্ণেশ্বর), এছাড়া কাশী বিশ্বনাথের অধিষ্ঠান__! ভগ্নপ্রায় হওয়ায় পরিচালন কমিটি নতুন মন্দির তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন।

মন্দির গাত্রের অলংকরণ বেশ দৃষ্টিনন্দন! মেঠো রাস্তা দিয়ে চলেছে গরুর পাল।দুর্ভেদ্য,দুর্গম জঙ্গল_গা ছম ছমে! দুর্লভ হরিতকী,বয়রার গাছ!

জনশ্রুতি, এক ব্যবসায়ী দু' টি শিলাখণ্ড নিয়ে রান্না করতে যান; রান্না রক্ত বর্ণ হয়ে যায় বারম্বার।রাত্রে স্বপ্ন দেখে বুঝলেন,শিলাখন্ড দু'টির একটি শিব স্বয়ং। আশ্চর্য্য বিষয়, মহারাজও ওই একই স্বপ্ন দেখেন ও মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন।

মন্দিরটি 16-17 বছরের পুরনো।আগে ছিল টালির ঢালাই।একটি বজরঙ্গবলির প্রস্তর খণ্ডও প্রাপ্ত এখানে।

25% জমি রাজারা দান করেন মন্দিরকে।সেই গন্ধবণিক ( ব্যবসায়ী) দেহরক্ষা করেন এখানে।তার জীবদ্দশায় রাজার নিকট তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন,শিবের পদতলে যেন আশ্রয় মিলে তার! বর্তমান পুরোহিতেরা শিবের পুজোর পরে  বণিককে  জল ও ফুল - বেলপাতা প্রদান করে থাকেন।

ডহরি খাল,ঝর্ণা,ইত্যাদি :

কুমীর হা মুখ - এর আকর্ষণ যুক্ত এই ডহরি খাল।এটির সঙ্গে জড়িত এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা,যে খবরটি বঙ্গের নানান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ফলাও করে। ঘটনাটি ঘটে 2006 সালের বর্ষাকালে।এক বৃষ্টি-বাদলার দিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী বসে ছিল কুমীর হামুখ পাথরের উপরে ,জলের তোরে ভেসে গিয়েছিল তারা।

স্থানীয় ভাষায় উক্ত ' মাকরকেদি ' ফল ফাটিয়ে খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন গোরু ,ছাগল চড়াতে আসা মানুষের দল।এটি বনভোজনের আদর্শ জায়গা।প্রকৃতি কৃত্রিমতার আদলে হাঁড়ুয়া ঘাঁটা চাটানটি সৃষ্টি করেছেন।এখানকার ঝর্ণা হতে শোবা নদী গিয়ে মিশেছে সুবর্ণরেখায়।পাহাড় আর  হাঁড়ুয়াঘাঁটা চাটান অদ্ভুত জায়গা ;বেশ প্রশস্ত, প্রকৃতির মাঝে উদার এক স্থান__ পাখির রব,ঝর্ণার কলতান ,অ্যাডভেঞ্চার ,আরেকদিকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা!

একটি গুহার উপস্থিতি তত্ত্ব- তালাশে জানান দেয় একদা ভল্লুকের বাসস্থানের কথা।এখন কি আছে জানতে পারলে জ্ঞাত করবেন, পাঠক বন্ধুরা,প্লীজ। জিরিজিরি সহ আরো দুয়েকটি নদীর জলের ধারা এসে মিশেছে আলোচ্য ডহরি খালে।হরপাবনে পশুরা এলে অনেক সময় তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় জলের প্লাবন।

জঙ্গলের পথে ক্লান্ত পথিকের বিশ্রামের স্থান 'বিরাম দহ'।


কুকুর জবড়া খাল:

রয়েছে কুকুর জবড়া খাল।এটি নামেই কাটে।'জবড়া ' শব্দের অর্থ 'ভিজে'__সম্ভবতঃ এককালে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের গৃহপালিত কুকুরকে স্নান করিয়ে নিয়ে যেতেন এই জলে।খুব কম মানুষই ভ্রমণ করেছেন এই অজ্ঞাত জায়গা গুলিতে।সকালে যারা বনে যান,তারা জানেন হাতীর দল সেদিন কোথায় অবস্থান করছে।তাই আচমকা বিপদ এড়াতে স্থানীয় গাইডের সঙ্গেই আসা সমীচীন এধরনের অফবিট ভ্রমণে।

চারপাশ পাহাড় বেষ্টিত। এমন পরিবেশে কার মনে সারা না জাগায় কালপুরুষের কবিতায় প্রাপ্ত লাইনগুলি!

____ " বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি............


দেওলঘাটা মন্দির, পুরুলিয়া:

শুনেছি,এই সব বোল্ডার পাথর ডুবে যায় বর্ষায় কুলুকুলু রবে বয়ে যাওয়া নদীতে।তখন পাহাড় আর  জঙ্গল ! সেখানে নদীতীরে মন্দির!!__ অপূর্ব নিজস্বতা!

একদিনে বানানো মন্দিরগুলি,লোকে বলে। হর হর মহাদেব __ 400 বছর আগেকার মন্দির।বহু মানুষ পুজো করতে আসেন।অর্পিত জল আর দুধ বেরিয়ে  যাওয়ার একটি চ্যানেল রয়েছে।একদিনে নির্মীত ওই মন্দিরের চূড়াটি অপূর্ব ! ত্রিভুজাকৃতি অপূর্ব যজ্ঞস্থান! কালীমূর্তিও রয়েছে__ নদীগর্ভ হতে বের হয়েছে এই মূর্তি। ইতিহাস বলে, আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তিগুলির গল্পকথাও ।


কোকিলের কুহুতান আর পলাশরাঙা লালমাটির পুরুলিয়ার বসন্তের মাধুর্য্য অনুভব করতে হলে যেতে হবে অজানা অচেনা কুহুবুরুতে।water fall উপভোগ করতে হলে পৌঁছাতে হবে বর্ষাকালে পলাশবনীতে ,যেটি পাঠক বন্ধুদের জন্য তোলা রইল।পলাশের পথ দিয়ে আরও আরও অনেক পলাশের মেলা খুঁজতে ঝালদার দিকে যাওয়া যায়_ কালিমাটির জঙ্গলে।বাঁধডিহি ড্যাম, কালীমাটিতেও মন না ভরে তো এগিয়ে চলা যায় জাজাহাটুর দিকে।পলাশ বনেরা নিজেদেরকে এমনভাবে মেলে ধরেছে যে কোন বনটি কার চাইতে সুন্দর ,বলা দুরূহ।

বরাভূম স্টেশনের পর পার্ডি লেক।এখানে ক্যাফে কাম ইকো স্টে আছে।গ্রামের বাড়িগুলির দেওয়ালের কারুকাজ সুন্দর। দেওয়ালীর সময়ে জামাই বাঁধনা উৎসবে বাড়িগুলি এভাবে সজ্জিত হয়েছে।

সামান্য দূরত্বে পাখি পাহাড় রয়েছে।শাল, সেগুন,মহুয়া, পলাশের বন দু'পাশে।হায়না, হাতী,ময়ূর আছে।দূরে  পাখি পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

একটি মহিলা স্বনির্ভর দলের যেকোনও একজনের সাহায্য নিতে হবে 200টাকার বিনিময়ে। স্থানটির অনুভূতি  রহস্যময়, রোমাঞ্চকর।পাহাড়ের গায়ে চিত্র খোদাই  করা আছে। রঙ করা হয়নি। 

ইতিউতি ছড়ানো বেশ কিছু অখ্যাত জলাধার রয়েছে। কুমারী জলাধারটি তারমধ্যে অন্যতম। থই থই জলে  সকাল-বিকেল মাছ, গুগলি, নানারকম শাক, তরকারী ...।খাদ্যের অভাব হবার কথা নয়।কিন্তু জলাধারে জল না থাকায় ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে শীত-গ্রীষ্মকালীন পাখিরাও; চোখে পড়ে না কাঁদাখোচা, কচ-গুগলি, টেটই কিম্বা সারস দেরও।


বৃষ্টির জলে পুষ্ট পুরুলিয়া উপযুক্ত বৃষ্টির অভাবে দিনদিন রুক্ষ হয়ে উঠেছে আরও।ফলে চাষবাস হচ্ছে না।অর্থের অভাবে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে ভিন রাজ্যে।জেলাটিতে প্রতি পরিবারেরই দুয়েকজন সদস্য বাইরে  রয়েছেন।অন্যথায় , পারিবারিক অর্থের যোগান কোনও মতেই সম্ভবপর নয়।

অর্থনৈতিক দিক থেকে জেলাটি ক্রমশঃ পিছনের সারিতে চলে আসার প্রধান ও একমাত্র কারণ এই চাষের জলের ঘাটতি।এই সমস্যার সমাধান করতে অবলম্বিত একমাত্র উপায় হয়ে উঠুক জনগণের শুভেচ্ছা।তবু দেবী পলাশ প্রিয়ার  আশীর্বাদ ঝরে পড়ুক  আদুরে রাঙ্গা পাথুরে ডাঙ্গার উপরে, এই শুভ কামনা রইল।


পাঠক বন্ধুরা,বারোমাসে পাথুরেডাঙার তেরো-পার্বণের সঙ্গী হয়েই দেখুন না,যদি  নতুন নতুন আরও কোনও পথের দিশা দিতে পারেন।

জল নামক সহজতম শব্দটি পাথুরেডাঙায় ততোধিক কঠিনতম বিষয় হয়ে উঠেছে কালান্তরব্যাপী! এর অন্যতম কারণ নদী - সংকট আদি বেশ কিছু বিষয়!

নদী - সংকট: শহরে পানীয় জলের যোগান আসে কাঁসাই নদী থেকে।সেখানে রয়েছে গভীর নলকূপ।নদীর বুক  চিরে আনীত জল শহরে সরবরাহ হয় প্রায় কুড়ি হাজার বর্গফুট অঞ্চল জুড়ে। ফলে নদীতীরবর্তী গ্রামগুলির নলকূপ গিয়েছে শুকিয়ে।শিমূলিয়া,দামদা,কোটলই প্রভৃতি গ্রামে গরমকালে নলকূপ, কুঁয়োয় জল মিলে না।তবে সরকারী তরফে ' জল ধরো জল ভরো ' প্রকল্পে প্রচুর জোড় বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।


জলের সবচাইতে বেশি সমস্যা হয় পাহাড় ও পাহাড়তলির আদিবাসী গ্রামগুলিতে।গরমে জলস্তর এতটাই নেমে যায় যে, তিন শো ফুট গভীর পাইপও জলের নাগাল পায় না। জলের বিষয়ে গভীর দুঃখময় পরিস্থিতিতেও মজার কথা হল, নলকূপে জল না থাকলেও ঝর্ণায় জল থাকে।গরম কালে সেই ঝর্ণার জলই ভরসা। বড় জলাশয় বা জলাধারগুলিকে কিভাবে ব্যবহার করা যায়, তা খতিয়ে দেখার কাজ চলছে।এক শো দিনের কাজের প্রকল্পে  জল সংরক্ষণের  উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।


পাথুরেডাঙ্গার ঢেউ খেলানো জমির উপর বেশির ভাগ জায়গাতে টিলা ও পাহাড়ের অবস্থান।ফলে নদীখাতগুলি অত্যন্ত গভীর। পুরুলিয়া জেলার প্রধান প্রধান নদীগুলি হল দামোদর, কাঁসাই, সুবর্ণরেখা,কুমারী,দ্বারকেশ্বর,শীলাই এবং টটকো।এই সাতটি বড় নদী ছাড়াও একুশটি ছোট ছোট নদী রয়েছে; সেগুলির মধ্যে অন্যতম হনুমাতা,বেকো, উতলা,পাঁড়গা, রূপাই,পাতলই, জাম, তারা,কারকা, চাকা, হাড়াই,আমরুহাঁসা, লাঙ্গাসাই,শোভা,কুদলুং,বান্দু,শালদা, তসের কুয়া,কদমদা,গোয়াই ।এতদ্ব্যতীত এক-একটি পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে তিন-চারটি করে জোড়।এছাড়া পাথুরেডাঙ্গার বিভিন্ন জায়গাতে রয়েছে বেশ কিছু বড় বড় বাঁধ বা দীঘি।সাহেব বাঁধ (পুরুলিয়া) তার মধ্যে অন্যতম।এই বড় বড় বাঁধ বা দীঘিগুলি ছাড়াও পাথুরে ডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বহু জলাশয়;আর আছে বিভিন্ন আকার ও গভীরতার পুষ্করিণী।


তবু ফাল্গুন,চৈত্র,বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য __ এই চারমাস জলের জন্য তীর্থের কাকসম প্রতীক্ষা করতে হয় এখানকার মানুষকে।


বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদ-নদী ও পুকুর শুকিয়ে সাদা হয়ে যায় ফাগুনের শুরু হতেই।নদী - প্রবাহ শুকোতে না শুকোতেই দ্রতগতিতে নীচে নামতে শুরু করে ভূ - জলস্তর।ক্রমে একে একে শুকিয়ে যেতে থাকে কুয়ো ও নলকূপগুলি।


সরকারি উদ্যোগে পাথুরেডাঙ্গাতেও নির্মিত হয়েছে ছোট, বড় নানা জলাধার বা ড্যাম;__ গৃহীত হয়েছে বহুমুখী নদী-পরিকল্পনাও। নয় নয় করে পুরুলিয়ায় বড় জলাধার বা ড্যাম রয়েছে প্রায় ১৮ টি।এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য __ *পাঞ্চেৎ _ নিতুড়িয়া থানা,

*মুরগুমা _ বেগুনকোদারের সন্নিকটস্থ ঝালদা থানা,

* পুটিয়ারী _ হুড়া থানা,

* লহরিয়া_অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে,বাগমুন্ডি থানায়, 

 * সাহাবজোড়, ইত্যাদি।


সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গ্রামে - গঞ্জে ও শহরে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য পাতকুয়া, এমনকি বিশালকায় কিছু ইঁদারাও।পঞ্চায়েত থেকে বসানো হয়েছে নল-কূপ,এমন - কি খনন হয়েছে পুকুরও __ গ্রীষ্মের প্রারম্ভেই যেগুলি শুকিয়ে যায় ! জেলাটির  বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বসবাসকারী মানুষকে পানীয় জলের জন্য এখনও নির্ভর করতে হয় শুকিয়ে যাওয়া নদীর ধবধবে বালুকারাশির মাঝে খনন করা চুঁয়ার উপরেই। গ্রামাঞ্চলের মানুষ সার বেঁধে আজও জল আনতে যায় নদীতে_ ঠিক  পুরাতন যুগের গ্রামীণ গল্প-গাঁথার ন্যায়!


আসলে সেই শৈশব হতে শুনে আসছি পুরু লিয়ার জল - কষ্টের কথা।এক বান্ধবীর কথা বলি,সে 1981- 82 সালের কথা। ওঁরা পুরুলিয়ায় সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত থাকলেও অকাল পিতৃ-বিয়োগের ফলে চলে আসে কলকাতায়।লিপিকার কাছে শুনেছি, সরকারি সুবিধা-প্রাপ্তি কালেও স্নানের জল, পানীয় ,রন্ধন থেকে শুরু করে চাষবাস সকলই স্তব্ধ হত সেখানে প্রায়শঃই।ওখানে খুব ভালো স্কুলে ওরা ভাইবোনেরা পড়াশোনা করত।শুধু মাত্র জলের অভাবজনিত কারণেই  ওরা কলকাতায়  এসে পড়েছিল।অনেক খুঁটিনাটি পুরুলিয়ার কাহিনী ওর কাছেই শোনা।


বেড়াতে এসে আমাদের আশ্রয় মিলেছে অযোধ্যার হিলটপে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে শুনলাম,অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন ব্লকগুলির বেশ কিছু এলাকায় কুয়ো খুঁড়লেও নাকি মিলে না জলের দেখা। 

শুনলাম, কুমারী নদীর জলধারা শুকিয়ে যায় ফাগুনের ঠিক মাঝামাঝিতে।তখন নাকি বালিতে এক-দেড় মানুষ সমান গর্ত খুঁড়ে বের করা হয় জল। নলকূপগুলি নির্মাণের পর হতে অব্যবহৃত থাকায়  পান করতে গেলে জল আটকে যায় গলায়।


বৃষ্টির জলে পুষ্ট পুরুলিয়ায় চাষবাস করে কারবার দ্বারা জীবিকা না হোক কমসে কম নিজের পরিবারের প্রয়োজন মিটাতে অল্প-স্বল্প কৃষিকাজটুকুও করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।

প্রতি পরিবারের দু-এক জন ছুটছেন ভিনদেশে,রুজির সন্ধানে।


অর্থনৈতিক দিক হতে পুরুলিয়ার দুর্দশামোচন করে তাকে সামনের সারির  জেলা বানাতে হলে শুভ ও অভিনব বুদ্ধির শাণিত ছুরিকাঘাতে দুর করতে হবে পাথুরেডাঙ্গার ঊর্ধগামীতার প্রধান অন্তরায় পানীয় জলের ঘাটতি।আমার প্রিয় পাঠকবন্ধুদের সুচিন্তিত মতামতে যথাসম্ভব দ্রুততায় সমৃদ্ধ  হোক পুরুলিয়া তথা বাহামনির পলাশবনী ,কিম্বা পলাশপ্রিয়ার প্রিয় পুষ্পে ঘেরা বাংলার রুক্ষ- সূক্ষ হাহাকারময় অথচ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মোহে পর্যটক আকর্ষণকারী জেলা__ আমার  স্বপ্নকল্পনায়  ভরা আদুরে রাঙ্গা  পাথুরেডাঙ্গার ললাটের লিখন!!


****************

*************************



















,   





 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জনারণ্যে বাংলা গানের পাখি

জাগো সবলা !