দ্বীপান্তরের অন্তঃপুরে

 প্রকৃতি মায়ের সান্নিধ্য আকাঙ্ক্ষা কে না করে! ' ঘর হতে শুধু  দুই পা ফেলিয়া ' দেখা শিশিরবিন্দু সুলভ, তা মানি।তবু অজানাকে জানবার আগ্রহ আর ইতিহাসের স্মৃতি - বিজড়িত দুর্গম স্থানগুলির রোমাঞ্চকর সৌন্দর্য্য যে হাতছানি দেয় ভ্রমণ পিপাসুদের।মনে পড়ে যায় John Keats - এর সেই ছন্দোবদ্ধ উক্তিটি _ " Beauty is truth; truth beauty' _ that is all./Ye know on earth, and all ye need to know",... সেই রোমাঞ্চে শিহরিত হতে পাড়ি জমিয়েছিলাম দ্বীপান্তরের অন্তঃপুরে _ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে।

ছোটবেলায় মানচিত্রে দেখে ভাবতাম মহাসাগরে ভাসমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভূ - খণ্ড _ সেখানে কাক-পক্ষীও নেই। এরপর জানলাম, কঠিনতম অপরাধের শাস্তি _ আন্দামানে চালান।এই অবুঝ জ্ঞানভান্ডারে ছুরি - কাঁচির আঘাত পড়ল ১৯৮৬-৮৭ সালে যখন রামমোহন কলেজ থেকে হর্ষবর্ধন জাহাজে চড়ে আন্দামানে গিয়ে সেখান থেকে ' ওঙ্গী ' ধরে এনে তাদের বংশবৃদ্ধির পরীক্ষা - নিরীক্ষা ও গবেষণার বিষয়ে কথা উঠল।বাড়িতে বাবা - মায়ের মাথায় হাত, ' সে কী! ওরা তো এখনও বর্বর, সভ্য জগতের মানুষদের দেখলেই বিষ মাখানো তীর ছুড়ে মারে!' আমি তো নাছোড়বান্দা। বাবাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলাম।বাবাও ঠিক আমারই মতো রোমাঞ্চপ্রিয়। তবু জানি না কীভাবে যেন অভিভাবকরা বুঝিয়ে - সুঝিয়ে আমাকে শান্ত করে ফেলল।তখনকার মতো মাথা থেকে আন্দামান - অভিযানের ভূত পালাল।

ধামাচাপা পড়া সত্যটি আবার মাথাচাড়া দিল 2019- এর প্রাক্কালে।আমরা ' ত্রয়ী ' ( কর্তা ও পুত্রসহ আমি )  উদ্যত হলাম আন্দামান ভ্রমণে।শুরু হল দিনক্ষণ দেখা_ হোটেলের খোঁজ,তাপমাত্রা সন্ধান,ইত্যাদি ইত্যাদি। জ্ঞাত তথ্যের সংক্ষিপ্ত পঞ্জিটি হল_




আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ:

ক্ষেত্রফল:                           8,249 বর্গ কিলোমিটার

মোট দৈর্ঘ্য:                            726 কি.মি.

মোট সৈকত রেখা:              1,962 কি.মি.

দ্বীপের সংখ্যা:                     572

মনুষ্যবাসকারী দ্বীপের সংখ্যা:   37

জনসংখ্যা:(২০১১- এর হিসেব অনুযায়ী) 3,80,581

কলকাতা থেকে পোর্টব্লেয়ারের দূরত্ব: 1,255 কি.মি.

বনাঞ্চল:                                          7,171কি.মি.

বিভিন্ন আদিবাসীদের সংখ্যা:

১) জারোয়া:                          425      

২) শম্পেন:                             219

৩) আন্দামানী:                           57

৪) নিকোবরী:                    27,686      

৫) ওঙ্গী:                                  112

৬) সেন্টিনেলি:                           50

জাতীয় উদ্যান:                  9

অভয়ারণ্য:                        96

জাতীয় পশু:                      ডুগং ( সামুদ্রিক                                                গাভী )

জাতীয় বৃক্ষ:                      প্যাডক

তাপমাত্রা:(ফেব্রুয়ারি মাসে) 22- 30ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড 

বৃষ্টিপাত:                            বছরে ১৮০দিন(প্রায়)

1956 সালে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়।এটি প্রধানতঃ তিনটি অঞ্চলের সমষ্টি।প্রথমটি হল নিকোবর যার সদর দপ্তর কার- নিকোবর দ্বীপে,দ্বিতীয়টি দক্ষিণ আন্দামান যার সদর দপ্তর পোর্টব্লেয়ারে।এই পোর্টব্লেয়ার আবার সমগ্র আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক রাজধানী।তৃতীয়টি হল উত্তর ও মধ্য আন্দামান যার সদর দপ্তর মায়াবন্দর। 

এই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপগুলিকে একটি কাল্পনিক রেখা দ্বারা যোগ করলে মোটামুটি ধনুকাকৃতির একটি চেহারা পাওয়া যায় যার অবস্থিতি মায়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার মাঝামাঝি।এই দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমদিকে বঙ্গোপসাগর ও পূর্বে আন্দামান সাগর।এই দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণতম বিন্দুটি ইন্দোনেশিয়া থেকে মাত্র ১৫০ কি.মি.(প্রায়) উত্তরে।

সমুদ্রের উপরে এই আন্দামান ও নিকোবরের ছোট ছোট দ্বীপগুলি আসলে সমুদ্রে নিমজ্জিত কতিপয় পর্বতমালার সমুদ্র উপরি স্থলভাগ বা চূড়াও বলা যেতে পারে।এই কারণে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে বিস্তীর্ণ সমভূমি খুবই কম দেখতে পাওয়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ উত্তর আন্দামানের ডিগলীপুর ইত্যাদি মাত্র দু '- একটি সমভূমি স্থানই উল্লেখ্য।উত্তরদিকে সমুদ্রে নিমজ্জিত রাখাইন ও পাটকাই পর্বতমালা এবং দক্ষিণে মেন্টাওয়াই পর্বতমালা ও এভাবে সৃষ্টি করেছে কয়েকটি দ্বীপ।এই মেন্টাওয়াই পর্বতমালারই একটি সমুদ্রোপরি অংশ আন্দামানের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে প্রায় ১৫০ কি.মি. দূরত্বে ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপের অন্তর্গত হয়েছে।

এই শতাব্দীর প্রথমদিকে উত্তর আন্দামানের ব্যারেন আইল্যান্ড বা বন্ধ্যাদীপে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দেখা গিয়েছিল। মার্কোপোলোর ভ্রমণ কাহিনীতেও এই দ্বীপপুঞ্জের উল্লেখ পাওয়া যায়।আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপগুলির নামকরণের মূল সূত্র বিষয়ে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য ধারণাটি হল ' আন্দামান ' নামটি এসেছে রামায়ণের ' হনুমান ' থেকে এবং ' নিকোবর ' নামটির সূত্র দক্ষিণভারতীয় শব্দ ' নাক্কাভারাইন ' যার অর্থ ' উলঙ্গ মানুষের দেশ '।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ চার ধরনের নেগ্রিটো আদিবাসীর আবাসস্থল _১) গ্রেট আন্দামানিজ,২) ওঙ্গী,৩) জারোয়া এবং ৪) সেন্টিনেলিস।অন্যদিকে নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আবার দুই ধরনের মঙ্গোলয়েড উপজাতির অধিষ্ঠানক্ষেত্র_১) শম্পেন এবং ২) নিকোবরীজ।

সমগ্র আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে প্রাকৃতিক ভাবে মিষ্টি জলের সন্ধান মেলে একমাত্র গ্রেট নিকোবর দ্বীপে।

গন্তব্যস্থানের তথ্য সংগ্রহ মোটামুটি সম্পূর্ণ করবার পর টিকিট কাটা হয়ে গেল Vistara Airlines - এ 12.02.2019- এ দমদম থেকে ছাড়বে10.50a.m.- এ আর পোর্টব্লেয়ার পৌঁছাবার কথা 1.05 p.m.- এ।

আমার ছেলে বাপটুস বড় হবার পর থেকে বেড়াতে গেলে তিন জনের আলাদা ব্যাগ নেওয়া হয়।তিনটি ব্যাগে যার যার জরুরী জিনিস ভরা হল। ক্রসচেকিংও হল।ওষুধ পত্র, টিকিট,পরিচয়পত্র ইত্যাদি সুরক্ষিত হল।

অবশেষে নির্দিষ্ট দিনটি সমুপস্থিত। সকাল 10.50 a.m.- এর বায়ুযানে চড়বার জন্য সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে একটি ভাড়া করা চতুর্চক্রযান মারফৎ পৌছালাম দমদম বিমানবন্দরে যেটির বর্তমান নাম ' সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট '।

ইতিপূর্বে আমরা একাধিকবার বায়ুযানে সফর করলেও একসঙ্গে তিনজনের আকাশপথে যাত্রা এই প্রথম।মনে হচ্ছিল এয়ারপোর্টের প্রতীক্ষালয়ে চেয়ার তিনটি আমাদের সাময়িক বৈঠকখানা।ক্রমে পার্শ্ববর্তী যাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে সেটি যৌথ পরিবারের অনুভূতি জাগাচ্ছিল।একে অপরের গন্তব্যের আগাম আভাস পেয়ে যাত্রীরা পরস্পরকে বিভিন্ন তথ্য ও ঘোষণার বিষয়ে সজাগ ও সচেতন করছিলেন।আমি আর বাপটুস মোবাইলে স্থান কাল পাত্রের সাক্ষ্য স্বরূপ কিছু নিজস্বী তুলে রাখলাম।এরপর শুধুই প্রতীক্ষা আর চোখ কান খুলে ঘোষণায় নজরদান।শুরু হল আমাদের বিমানটির ঘোষণা।সময়মতো নিরাপত্তা চেকিং - এর পর চড়ে বসলাম বিমানে।সৌভাগ্যক্রমে জানালার ধারে দু'টি সিট আমাদের বরাদ্দ ছিল।তার একটিতে বাপটুস আর অন্য সারিতে আমি।তৃতীয় পার্শ্ববর্তী সিটটির অধিকারী কর্তা মহাশয়।

কিছুক্ষণ সমতলের উপর দিয়ে চলতে চলতে হুস্ করে পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে চলল আকাশপথে_ কলকাতার ঘরবাড়িগুলি ছোট হতে হতে ক্রমশঃ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে অবশেষে ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেল।বিমান সুন্দর বনের দিকে... মুহূর্তে উড়ে চলল মহাসাগরের উপর দিয়ে। নীচে জল আর জল; উপরে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ।তার ভিতরে আমরা।আর হাত বাড়ালেই কল্পনার স্বর্গ... ।সুন্দরী বিমানবালারা বিমানে আবশ্যক সতর্কতার বিষয়ে কিছু পূর্বেই জ্ঞাত করেছিলেন।এখন কফি ও খাবার পরিবেশন আর যথাসাধ্য আতিথেয়তা প্রদর্শন করলেন।প্রায় সওয়া দু' ঘণ্টা পর অবতরণ পোর্টব্লেয়ারের ' বীর সাভারকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে '- এ। বৈমানিক নিয়ম-নীতি পালনের পর একটি গাড়িতে চেপে সারথি মঙ্গলের সঙ্গে পথ চলে মালপত্রসহ ওঠা হল একটি সুদৃশ্য বিলাসবহুল হোটেলে।সেখানে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ঐ মঙ্গলের গাড়িতে চড়েই সেলুলার জেলের অভিমুখে। যাত্রাপথে অনুভব করছিলাম বিশাল জলরাশি বেষ্টিত ক্ষুদ্র কয়েক টুকরো ভূখণ্ড আঁকড়ে জীবনধারণ করছেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মানুষ_ আর এই মুহূর্তে আমরাও।সেলুলার জেলে টিকিট কেটে প্রবেশ করা হল।ব্রিটিশ আমলের সেই কুখ্যাত ' কালাপানি ' জেল!

সেলুলার জেল: ভারতবর্ষে প্রায় ২০০ বছরের নিঠুর ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম উদাহরণ সেলুলার জেলের কাণ্ডকারখানা।প্রথমেই বলে রাখা ভালো,এটি এখন আর জেল নয়।এর বর্তমান মর্যাদা National memorial অর্থাৎ জাতীয় স্মারকের।জেলের ছাদ থেকে সাগর শোভা দেখতে ভারি অপূর্ব! মূল জেলটির নির্মাণ শুরু হয় 1893 সালে ; আর কাজটি সম্পূর্ণ হয় 1906 সালে।

কারাগারটি তারামাছের ডানার তারের মতো দেখতে। অন্যভাবে বললে,একটি বাইসাইকেলের চাকায় যেমন অনেকগুলি স্পোক থাকে ,অনুরূপে একটি তিনতলা বাড়িতে বাইসাইকেলের চাকার spoke- এর ন্যায় সাত খানি উইং - এর সমষ্টি ছিল_ সবই তিনতলা। এখানে মোট ৬৯৩ টি সেল বা কুঠুরী ছিল।

সাগরের জলে ছিল হাঙর, অন্যদিকে সেন্ট্রাল টাওয়ার থেকে নজরবন্দি ছিল প্রতিটি সেল।ওই টাওয়ারের মাথায় ছিল একটি বড় ঘণ্টা।কম উচ্চতার দেওয়াল টপকে কোনও বন্দীর পক্ষে জলে ঝাঁপ দিয়ে পলায়ন ঠিক যেন শাঁখের করাতের মতো_ হয় হাঙরের পেটে যাওয়া, নচেৎ প্রহরীর নজরদারিতে বড় ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দে ধরা পড়ে ততোধিক সাজা এমনকি মৃত্যুলাভ। এখানকার ফাঁসিঘরে একসঙ্গে তিনজন বন্দীকে পাশাপাশি শূলে চড়াবার ব্যবস্থা ছিল।

ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা রাজনৈতিক বন্দী দেরই প্রধানতঃ স্থানান্তরিত করা হতো এই কারাগারে বন্দীদের প্রতি শাস্তিমূলক পরিশ্রমের অন্যতম ছিল হাজার হাজার নারকেল ছাড়ানোর কাজটি।বন্দীদের তেলের ঘানি চালিয়ে তেল উৎপন্ন করতে হতো।যে সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ তেল উৎপাদন সম্ভব নয়_ তা-ই এক - একজনের কাজের বরাদ্দ হিসেবে জুটত। অনিবার্য অসাফল্যের কারণে একটি দন্ডায়মান স্লিপারের সঙ্গে বেঁধে মারত ইংরেজ জেল কর্তৃপক্ষ।জেল কর্তৃপক্ষের এই চূড়ান্ত অত্যাচারের প্রতিবাদে বন্দীরা বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করেন।অবশেষে জানুয়ারি, 1938 সালে এই জেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সমস্ত কারাবাসীদের ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়।

জেলের সাতটি উইং -এর মধ্যে ছ'টিই ঝড় ও ভূমিকম্পে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মাত্র একটিই বর্তমানে অবশিষ্ট আছে।জাপান কর্তৃক ভেঙে ফেলা অংশটিতে তৈরি হয়েছে গোবিন্দবল্লভ পন্থ হাসপাতাল।

সেলুলার জেল দেখার পর চলে এলাম নারকেল গাছে ঘেরা করবিনস্ কোভ বীচে।

করবিনস্ কোভ বীচ: পোর্টব্লেয়ার শহরটি থেকে আনু মানিক প্রায় ৭ কি.মি.দূরত্বে এই তটটি অবস্থিত।বিস্তর নারকেল গাছ মন ভোলায় আর নিশ্চিত করে তপ্ত দিনের জন্য ছায়া সুনিবিড় শীতলতা।প্রাচীন জাপানী বাঙ্কারটি এখনও বর্তমান,যদিও ভগ্নপ্রায়। সমুদ্র-স্নানের পক্ষে উপযোগী সৈকতটি সন্ধ্যেবেলাকার মৃদুমন্দ সমীরণ মারফৎ আমন্ত্রণ ও আহ্বান জানায় পথচারী পর্যটক দের।

ওখান থেকে আবার সেলুলার জেলে ফিরে ভিতরের চত্বরে টিকিট কেটে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখা।মাথাপিছু টিকিটের মূল্য একশ টাকা করে।অন - লাইনে টিকিট বুক করে তারপর কাউন্টারে নগদ অর্থ দিয়ে টিকিট মেলে।এই নিয়মটি পর্যটকদের পক্ষে অস্বস্তিকর হলেও খুব সম্ভবতঃ নিরাপত্তাজনিত কারণে এই ব্যবস্থা বলবৎ।এক ঘণ্টার শো সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত।এতে সেলুলার জেলের ইতিহাসটা ভালো করে জানা গেল।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানী ফৌজ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয় 23মার্চ, 1942 সালে।আর 7 অক্টোবর,1945 অবধি সেটি থাকে তাদেরই অধিকারে।

কারাগারটির বিভিন্ন দেওয়ালে রাজনৈতিক বন্দী ও ফাঁসি প্রাপকদের নাম মার্বেল ফলকে খোদাই করা আছে।এই কয়েক ঘন্টার ভিতরে আমি মনে মনে হয়ে উঠেছি স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগী ঐতিহাসিক কয়েদীদের একজন। কাজী সাহেবের সৃষ্টির কষ্টিপাথরে ঐকতান অনুভূত হল_

            " কারার ঐ লৌহ কপাট                                                 ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট ...

          __   ____ ____ ____ ____ ___

          লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দীশালায় __

          আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।"

একরাশ বেদনা বুকে বয়ে আমাদের ত্রয়ীর গতি_অগত্যা, হোটেলমুখী ।

দ্বিতীয় দিন(13.02.2019): সকালে জলখাবারের পর্ব সমাপনের পর পোর্টব্লেয়ারের চ্যাথামে চললাম সরকারী করাত কল ( শ মিল) দেখতে।আন্দামানে প্রাপ্ত কাঠের তৈরি নানান ধরনের আসবাবপত্র ও ঘর সাজানোর পসরা রাখা আছে এখানে।শ মিলটিতে কাঠ চেরাই করে কাঠের জিনিস তৈরি হয়।কাষ্ঠনির্মিত বিভিন্ন মূর্তি ও মডেলগুলি হৃদয় হরণ করে  আমাদের মতো পর্যটক দের। পরবর্তী গন্তব্য ন্যাভাল মেরিন মিউজিয়াম।

Naval Marine Museum: এখানকার বাগিচায় রুদ্রাক্ষের একটি চারাগাছ আমার মতো নগণ্য পর্যটকের নিকট একটি ব্যক্তিগত উপরি পাওনা। যাই হোক, বিভিন্ন ধরনের কোরাল অর্থাৎ প্রবালের সম্ভারে সুসজ্জিত এই সংগ্রহশালা।অনেকেই প্রবালকে এক ধরনের পাথর বলে ভাবলেও অন্তত এটি এক ধরনের প্রাণী বৈ নয়।পরবর্তী দ্রষ্টব্য অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম।

Anthropological Museum: এখানে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন আদিবাসীর জীবনযাত্রা বর্ণিত রয়েছে সুপরিকল্পিত মডেলের সাহায্যে।

আজকের প্রথম তিনটি দ্রষ্টব্য পরখ করে হোটেলে ফিরে দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর্ব সেরে অপরাহ্নের গন্তব্য স্থির হল চিড়িয়াটাপুতে অবস্থিত মুন্ডাপাহাড় বীচ।

সূর্যাস্তের অপরূপ শোভা দর্শনই এই তটের মূল আকর্ষণ। সমুদ্রের জলের উপরে সূর্যের লাল প্রতিফলন ভারি অপূর্ব! এই চিড়িয়াটাপুতে জলে নামা মানা।কারণ পারের খুব কাছে কুমির চলে আসে।সন্ধ্যেবেলায় পড়ন্ত সূর্যের বিদায়ী শোভার স্মৃতি সাথী করে হোটেলে প্রত্যাবর্তনের পথে একটি চা পানশালায় কতিপয় পশ্চিমবঙ্গীয় সরকারী কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে আলাপ হতে মনে হল দ্বীপান্তরে আমরা কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন নই;সাথে রয়েছে বঙ্গের কত পরিবার।অচেনা মানুষ গুলিকে খুব ঘনিষ্ঠ আপনার জন  বোধ হতে লাগল।

তৃতীয় দিন (14.02.2019): কাকভোরে রওনা হলাম।আমাদের উদ্দেশ্য জারোয়া অধ্যুষিত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করা।পোর্টব্লেয়ার থেকে 49 কি.মি. দূরত্বে যে জঙ্গলে জারোয়ারা বাস করে তা হল 'জিরকাটাং জঙ্গল '।যে সমস্ত গাড়িগুলি যাবে সেগুলির কোনওটিরই এককভাবে যাত্রার অনুমতি মেলে না।কারণ জারোয়ারা সংরক্ষিত উপজাতি (Protected tribe)। তারা সভ্যতার আলোয় আসেনি।এককভাবে যাওয়ার উভয়সঙ্কট  হল পর্যটকেরা জারোয়াদের গাড়িতে তুলে নিতে পারেন অথবা জারোয়ারাও একক গাড়ির সওয়ারদের প্রতি আক্রমণে উদ্যত হতে পারে।তাই সরকারী পদক্ষেপে সমস্ত গাড়িগুলিকে এক লাইনে আনা হয়।একে বলা হয় কনভয়।

চেকপোস্টে সমস্ত গাড়ি জমায়েতের পর সামনে আর পিছনে ফরেস্ট গার্ড ( Forest Guard )- এর গাড়ি থাকে। জঙ্গলে অনুপ্রবেশের পূর্বে সকলের নাম, ঠিকানা, পরিচয় পত্রের নকল (copy) বনদপ্তরের চেকপোস্টের অফিসে জমা দিতে হয়।জারোয়া ও পর্যটকপক্ষ যাতে পারস্পরিক সমস্যা সৃষ্টি না করে সেই মর্মে জঙ্গলটি জারোয়াদের রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে রক্ষিত হয়েছে।

জিরকাটাং খুব ঘন জঙ্গল।এর মধ্য দিয়ে ৪৭ কি.মি. দূরত্বসম্পন্ন পিচ বাঁধানো সরু রাস্তা। কোনও ক্রমে দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে।এই ৪৭ কি.মি. জঙ্গলই জারোয়াদের আবাসস্থল।গাছের,ঝোপের আড়ালে, জলাশয়ের আনাচে-কানাচে, গাছের কোটরে, ইতি- উতি সন্ধান করে চলেছি।জঙ্গল প্রায় শেষ।একটিও জারোয়া আদিবাসী চোখে পড়ল না। আফসোস আর অবিশ্বাস দানা বাঁধল।মনে হল পর্যটকেরা আজগুবি গল্প ফাঁদেন জারোয়াদের নিয়ে।এদের ঘটনা সত্যি হলে একটি ছোট্ট ছেলেও তো নজরে পড়ত। শিশু চরিত্র সর্বত্রই এক। গণ্ড গ্রামে গিয়ে দেখেছি গাড়ি প্রবেশ করলে পিছনে পিছনে ছুটে আসে ছোট্ট ছেলের দল।কই সেরকম কিছু তো মিলল না।

এদের নিয়েই ভাবছিলাম।

গ্রেট আন্দামানীজ, ওঙ্গী এবং সেন্টিনেলিস উপজাতিদের মতো এরাও তো শুনেছি সম্ভবতঃ 55000 বছর যাবত মহাসাগরের বুকে বসবাস করছে।একটি পুস্তিকায় চোখ রাখলাম_ দ্বীপপুঞ্জের জনগণ বহু ভাষাভাষী।2011- এর আদমসুমারী (census) থেকে জানা যায় 28.49% জনগণের মাতৃভাষা বাংলা। এছাড়া হিন্দি 19.19%, তামিল 15.20%, তেলুগু 13.24%, নিকোবরীজ7.65% এবং মালয়ালম 7.22% জনগণের মাতৃভাষা।অন্যদিকে সেন্টিনেলিসদের ভাষা পুরোপুরি সাংকেতিক।সমুদ্রের ধারের কাছে এসে থামল কনভয়।অতএব, জারোয়া রিজার্ভ ফরেস্টের সীমানা শেষ।বিপরীত পারে কাছাকাছি একটি দ্বীপ _ ' বারাতং '।  

বারাতং দ্বীপ: এই দ্বীপে যাওয়ার জন্য সমস্ত গাড়ি জাহাজে উঠল।পাশাপাশি আমাদেরও স্থান সংকুলান হল।অপর পারে বড় জাহাজটি, পৌঁছে নোঙ্গর বাধল।এক - একটি স্পিডবোটে দু '- চারজন করে বাকি পথ অতিক্রম করতে হবে।আমরা এরকম একটি স্পিড বোট ভাড়া করে নিলাম। নৌযাত্রায় অনেকগুলি দ্বীপ দেখবার সৌভাগ্য হল। প্রতি জায়গায় জলের রঙের আভা আলাদা আলাদা। বারাতং দ্বীপের পর্যটকের আকর্ষণ বলতে ম্যানগ্রোভ অরণ্য (Mangrove)আর চুনাপাথরের  গুহা (Limestone cave ) দর্শন। স্পিড বোট আর যাবে না। এখানে সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ উপরে উঠে 300 মিটার দৈর্ঘ্যের কাষ্ঠনির্মিত পায়ে চলা পথ(সাঁকো) ধরে চুনাপাথরের গুহা 1.2 কি.মি. দূরত্বে।এপথে ম্যানগ্রোভের উপর দিয়ে কাঠের ভাঙাচোরা সিঁড়ি বানানো আছে মাঝে মধ্যে। ডাঙ্গা দিয়ে পদব্রজে চললাম আরও 900 মিটার আর প্রত্যাবর্তন ওই একই উপায়ে।

প্রাসঙ্গিক ম্যানগ্রোভের বিষয়ে সকলেই অল্পবিস্তর অবগত থাকলেও এর সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।

ম্যানগ্রোভের ফলটি হল ভিভিপোর (vivipore)।ফলগুলি সরু, সূচালো, লম্বাটে। গাছ থেকে জলে পতিত হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে শুরু করে। কিঞ্চিত কর্দমের সন্ধান পেলেই গাছ গজাতে আরম্ভ হয়।এভাবেই ম্যান গ্রোভের বংশবিস্তার।বারাতং দ্বীপের কাছাকাছি জলে হাঙর (আদিবাসীদের স্থানীয় ভাষায়    'বদমাশ')ও অন্যান্য বহু জলজপ্রাণী _ শঙ্কর মাছ,সার্ডিন, ঈল, টুনা মাছ, সুরমাই ইত্যাদি থাকে। ম্যানগ্রোভের শিকড়ের আশেপাশে চিংড়ি, কাঁকড়া _ এই সমস্ত সন্ধিপদ প্রাণীরা বাসা বেঁধে থাকে।

ম্যানগ্রোভ তার অসংখ্য ডালপালা দ্বারা ডাঙাটিকে আটকায় যাতে ভাঙন না ধরে, আর ভূমিক্ষয় রোধ হয়।এরা জলের ঢেউকেও বহুলাংশে প্রতিহত করে পারের ভাঙন রোধ করে।




Limestone Cave: বারাতং দ্বীপে যে চুনাপাথরের গুহা দেখা যায় সেটি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত বিশ্বের একাধারে বৃহত্তম ও গভীরতম লাইমস্টোন কেভ।এই চুনাপাথর বা limestone আদতে এক ধরনের sedimentary রক বা পাথর।এটি মূলতঃ আদিকালে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী _ শামুক, ঝিনুক এবং কোরালের একের পর এক আস্তরণ কোটি কোটি বছর যাবত সমুদ্রের নিচে জমে জমে পিষ্ট হওয়ার পর কোনও ভৌগলিক কারণে যখন সমুদ্রের ওই তলদেশটি, সমুদ্র তলের উপরে পাকাপাকি ভাবে উঠে আসে, তারই ফলশ্রুতি।এধরনের চুনাপাথরের গুহার একটি বিশেষত্ব হল যে এই চুনাপাথর সহজেই বৃষ্টির জলে দ্রবীভূত হয় ।বৃষ্টির জল যখন চুনাপাথরের স্তরের মধ্য দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে প্রবেশ করে তখন চুনা পাথর, বাতাসের কার্বন ডাই  অক্সাইড ও বৃষ্টির জলের বিক্রিয়ায় অ্যাসিডের উৎপত্তি হয়।এটি হাজার হাজার বছর ধরে ক্রমাগত ক্ষরণের ফলে চুনাপাথরের স্তরের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিশাল গহ্বরের। একেই বলা হয়ে থাকে চুনাপাথরের গুহা বা Limestone Cave ।

গুহার মধ্যে যখন উপর থেকে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে গুহার মেঝেতে পতিত হয় সেগুলি জমাট বাঁধার পর ধীরে ধীরে মেঝে থেকে লম্বা লম্বা খাড়া হয়ে থাকা এক ধরনের স্থাপত্যের সৃষ্টি হয়।এগুলির নাম স্ট্যালাকটাইট( Stalactite)।আবার এই একই ধরনের জিনিস যখন গুহার ছাদের থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়বার কালেই জমাট বেঁধে যায় তখন সেগুলিকে দেখে মনে হয় যেন গুহার ছাদ থেকে কিছু স্থাপত্য হয়তো বা ঝুলছে। এগুলির নাম স্ট্যালাগমাইট (Stalagmite)।গুহার মধ্যে প্রকৃতির নিজ হস্তে নির্মিত এই ধরনের অনির্বচনীয় স্থাপত্যের আশপাশ পার হয়ে আমরা এই লাইমস্টোন কেভের অনেকখানি ভিতরে প্রবেশ করে ফেলেছি।সহজে লিখে গল্পকথা শোনাচ্ছি বলে এ যাত্রা খুব আনন্দের বলে মনে করবার কোনও কারণ নেই। খানা খন্দর পেরিয়ে ক্লিষ্ট শরীরে এখানে এসে উপস্থিত হলেও মনে কোনও খেদ রাখা উচিত নয়, অবশ্যই। আসল কথা হল ভয়ে বুক দুরু দুরু করছে_ পিলে চমকাচ্ছে _ এই বুঝি সুবিশাল পাইথনের নজরে পড়ি।মনে পড়ছে গুপী - বাঘার সেই দুর্বিষহ বাঘের দৃশ্য _ ' তুমি যে এখানে কে তা জানত!' ইত্যাদি ইত্যাদি।ভয় দেখাতে চাই না।বাস্তবটুকু তুলে ধরবার চেষ্টা করলাম মাত্র। যত দুঃসাহসী বীর পাঠকই হন না কেন পর্যটকরা স্মরণে রাখবেন_ সাবধানের মার নেই।আর সাহস ভালো, দুঃসাহস নয়।

....আরও গভীরে অনুপ্রবেশ....!! গুহার গাত্রে অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণী ও জেলিফিস পর্যন্ত ফসিল (fossil) অর্থাৎ জীবাশ্ম হয়ে জমে আছে। এ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে এই গুহা একদা তৈরি হয়েছিল সমুদ্রের তলদেশেই।

লাইমস্টোন কেভ দর্শনের পর আবার সেই জংলি পথ ধরে প্রায় সোয়া (1.25) কি.মি. পথ পদব্রজে ফিরে আসা। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয় যে এই জঙ্গল এবং আন্দামানের বিভিন্ন দ্বীপে যত জঙ্গল আমরা ঘুরেছি_ সর্বত্রই দেখেছি সত্যিকারের মহীরুহ বলতে কী বোঝায় ! বিশালকায় গুঁড়ি আর আকাশছোঁয়া তাদের উচ্চতা।ভারতবর্ষের অন্য কোথাও এত বিশাল গাছ আমাদের নজরে পড়েনি কখনওই।আরেকটি বিষয় আমার পাঠক বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই_ আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বিচরিত উল্লেখযোগ্য সরীসৃপগুলি হল লেদারব্যাক কচ্ছপ ( Leather back 🐢), গ্রিন সি কচ্ছপ, ওলিভ রিডলি কচ্ছপ, রেটিকুলেট পাইথন,নোনাজলের কুমির, ওয়াটার মনিটর লিজার্ড প্রভৃতি।

 


 লেদার ব্যাক কচ্ছপ: এটি পৃথিবীর বৃহত্তম কচ্ছপের প্রজাতি।এদের এক একটির গড় ওজন প্রায় 800কেজি।এরা প্রধানতঃ খোলা সমুদ্রে থাকতে ভালবাসে এবং ডিম পাড়বার সময়ে বালুকাময় সমুদ্রকুলে আসে, আর একেবারে 90- 200 টি ডিম পাড়ে।

গ্রিন সি কচ্ছপ: এদের চেহারা বেশ চ্যাপ্টা ও পান আকৃতির।এরা জলজ উদ্ভিদ ও শৈবালকেই প্রধানতঃ আহার্য হিসেবে গ্রহণ করে ডিম পাড়বার সময়ে এরা বালুকাবেলাতে প্রায় 2ফুট গভীর গর্ত করে ও এক-এক বারে 350-600 টি ডিম পাড়ে।

ওলিভ রিডলি কচ্ছপ: খোলাসমূদ্র ও উপকূলবর্তী অঞ্চল _ উভয় স্থানেই এদের দেখা মেলে।এদের খাদ্য হল চিংড়ি, ছোট কাঁকড়া, জেলিফিস ও সামুদ্রিক শৈবাল। সেপ্টেম্বর - মার্চ মাসের মধ্যে মোটামুটি 90- 135 টি ডিম পাড়ে এরা

বলাবাহুল্য হলেও এত রকমের কচ্ছপের সম্পর্কে জানতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সংসারী মানুষের উপযোগী শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সেই অমৃতবাণীর ভাবটি _ কচ্ছপের মতো সংসারে থাক।কচ্ছপ নিজে জলে চরে বেড়ায় _ কিন্তু ডিম আড়াতে রাখে।সব মনটা তার ডিম যেখানে সেখানে পড়ে থাকে।

রেটিকুলেট পাইথন : আন্দামানের এই প্রাণীটি ভারতীয় পাইথনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ।এদের দৈর্ঘ্য 25 - 30 ফুট পর্যন্ত হয়।ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী,পাখি ও অন্যান্য সরীসৃপ ভক্ষণ করে এরা জীবনধারণ করে।এক - একবারে এরা প্রায় 100টি করে ডিম পাড়ে।

নোনাজলের কুমির : আন্দামানের এই কুমির পৃথিবীর বৃহত্তম কুমির। লম্বায় এরা 24 - 25 ফুট পর্যন্ত হয়।এদের খাদ্য হল ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী,পাখি, অন্যান্য সরীসৃপ এবং বিভিন্ন মাছ। ডিম পাড়বার সময়ে এরা নিজেরা অদ্ভুত চাতুর্যে একটি ঢিবি প্রস্তুত করে এবং তার মধ্যে 25 - 125 টি অবধি ডিম পাড়ে।

ওয়াটার মনিটর লিজার্ড: এরা জলাভূমি ও নদীতীরের সন্নিকটে অবস্থান করে।খাবারের সন্ধানে সমুদ্রের মধ্যে বহুদূর ঘুরে আসতে সক্ষম এরা।জুন - আগস্টের মধ্যে এক - একবারে 25 - 30 টি ডিম পাড়া এদের বৈশিষ্ট্য।

বারাতং দ্বীপ থেকে এবার ফেরার পালা।স্পিড বোটে চেপে প্রথমে সমুদ্রের খাঁড়ি বেয়ে প্রধান সমুদ্রে পড়লাম।অতঃপর বেশ কয়েকটি দ্বীপের পাশ দিয়ে এসে আবার সেই জিরকাটাং রিজার্ভ ফরেস্ট - এর কাছে ফিরে আসলাম।গাড়ি আগে থেকেই অপেক্ষমান। এখান থেকে জারোয়া অধ্যুষিত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কনভয় করে পোর্ট ব্লেয়ারে ফেরার কথা।এই ফেরত পথে যে এত অসংখ্য জারোয়ার সম্মুখীন হব তা ছিল কল্পনারও অতীত। পর্যটক দল ও পর্যটন দপ্তরের মন্তব্য, ' এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা '।সামনের রাস্তায় একসঙ্গে এত জারোয়ার আবির্ভাবে কনভয় থেমে গেল।ভীত সন্ত্রস্ত আমরা গাড়ির কাচ তুলে দিয়ে দুর্ধর্ষ আনন্দসহ ধৈর্য্যের বাঁধকে রক্ষা করতে লাগলাম।সহসা আমাদের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল দুধের শিশু কোলে নিরাবরণ এক জারোয়া মা।আমাদের সঙ্গে বিস্কুটের প্যাকেটসহ অন্যান্য শুকনো খাবার থাকা সত্ত্বেও চালকের উপদেশ মান্য করে গাড়ির কাচ নামিয়ে সেগুলি তাদের নিকট হস্তান্তর করতে পারলাম না। কারণ সরকারী আইন মোতাবেক কোনও প্রকার খাদ্যবস্তু ওই আদিবাসীদেরকে দেওয়া নিষিদ্ধ।ছবি তোলাও দণ্ডনীয় অপরাধ।জারোয়াদের সমর্থনে তাদের মর্যাদা দিতে সরকার একটি নির্দিষ্ট নীতি অনুযায়ী তাদেরকে নানাবিধ সাহায্য দান করে থাকেন।

জিরকাটাং জঙ্গল প্রায় শেষ।বোধ হল জীবিত ইতিহাস কথা বলেছে। স্মরণে এল ' ময়না ' ছায়াছবিতে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটির কয়েক কলি _ "... এই মানুষ ছিল বনমানুষের রূপে, ইতিহাসে বলে/ আদলটা তার বদলে গেছে দিন বদলের ফলে/শুনে অবাক হোয়ো না, চমকে উঠো না /..."

চমকে উঠবার অবকাশ কোথায় ! আশ্চর্য সুন্দর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে জঙ্গল শেষে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড ধরে পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় আটটা।সারাদিনের দীর্ঘ সফরে ভারাক্রান্ত শরীরে নৈশাহার সেরে শয়নের উদ্যোগ।

ক্লান্ত , পরিশ্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও অভ্যাসগত দূরদর্শনের নিউজ চ্যানেল অন করতেই ঘুম মাথায় উঠল। '... আজ জম্মু শ্রীনগর জাতীয় সড়কের পুলওয়ামায় গমনরত নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনীর কিছু গাড়ির একটি কনভয়ের উপর একটি গাড়িসমেত হামলা চালায় এক আত্মঘাতী জঙ্গী। ফলে 40 জন জওয়ানের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া প্রায় 35 জন জওয়ান গুরুতরভাবে আহত হন।...' এই গভীর বেদনাদায়ক ঘটনাটি এদিন বেড়ানোর সমস্ত আনন্দকে এক লহমায় নিরানন্দে পর্যবসিত করল।

চতুর্থ দিন (15.02. 2019) : এদিনকার অভিযান শুরু হল পোর্টব্লেয়ারের ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স থেকে।স্থানটির ঠিকানা আবেরদিন বাজারের নিকটস্থ জেটিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযোগ্য যে ভ্রমণ কাহিনী লেখবার সময়ে অর্থাৎ এই মাত্র ( 07.12.2019 ) পাওয়া খবরে প্রকাশ যে আমাদের ঘুরে আশা এই আবেরদিন police স্টেশনটি সারা দেশে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করেছে। যাইহোক, যাত্রা শুরু হল সকাল সাড়ে  আটটায়। জেটি থেকে Ocean Horse নামক স্পিডবোটে চড়ে আমরা রওনা হলাম। বোটটিতে আরোহণের পূর্বেই বারাতং যাত্রার মতো প্রত্যেককে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে একটি করে লাইফ জ্যাকেট পরিধান করানো হল। ওটিকে অঙ্গে ধারণ করা আমাদের মত অতি সাধারণ পর্যটকের পক্ষে অতিশয় অস্বস্তিকারক; তবু মহাসাগরের উপর দিয়ে স্পিডবোটে চড়ে দিক থেকে দিগন্তরে যাত্রার ক্ষেত্রে এটি যে অত্যন্ত জরুরী আগাম সতর্কতা, তাতে দ্বিমত নেই। অগত্যা!

স্পিডবোটে চড়ে সাগরবক্ষে বেশ কিছুক্ষণ ভ্রমণের পর উপস্থিত হলাম মাঝারি মাপের নর্থ বে (North Bay) দ্বীপে।দ্বীপটিতে কোনও পাকা বাড়ি ঘরদোর নেই। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সংস্থা নানান ধরনের ওয়াটার স্পোর্টস - এর ব্যবস্থাযুক্ত অ্যালুমিনিয়ামের ছাউনির নিচে যে যার নিজস্ব অফিস খুলে রেখেছেন ।এখানে পরিবেশিত ওয়াটার স্পোর্টসগুলি হল স্নর্কেলিং, স্কুবা ডাইভিং, সি ওয়াক,ডলফিন রাইড প্রভৃতি। প্রথম তিনটি স্পোর্টস - এর জন্য বিভিন্ন ধরনের উপযোগী পোশাক, পায়ের স্লিপার, অক্সিজেন মাস্ক ইত্যাদি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে।তরুণ - তরুণীরা সঙ্গে গাইড নিয়ে ওই সমস্ত ডুবুরি মার্কা পোশাক পরিধান করে স্পিডবোটে সমুদ্রের মাঝামাঝি বেশ কিছুটা যাবার পরে সাগরের নোনা জলে নেমে পড়ছে।কর্তা ও আমার সাহসে কুলালো না; উপরন্তু, আমাদের নিধিরাম সর্দার শ্রীমান বাপটুসকেও জলে নামা থেকে বিরত করলাম।

আমরা বেছে নিলাম 🐬 ডলফিন রাইড।

ডলফিন রাইড: ডলফিন আদতে খুব ছোট্ট একটি অত্যাধুনিক জাহাজ বৈ নয়।এর মাঝখানের নিচের অংশটি পুরোপুরি কাচ নির্মিত।এই গোলাকার কাচের তলদেশওয়ালা জায়গার চতুস্পার্শে বসবার সুন্দর পরিমন্ডল। এধরনের অত্যাধুনিক জলযান ভারতবর্ষে এই একটিমাত্র।এতে বসে আধ ঘণ্টা ভ্রমণের জন্য মাথাপিছু টিকিটের ধার্য্যমূল্য প্রায় দু ' হাজার টাকা করে।ডলফিনে চড়ে বসতেই জাহাজটি মাঝ দরিয়া অভিমুখে এগিয়ে চলল।আমাদের সম্মুখে জাহাজের তলদেশের কাচে ক্রমশঃ উন্মোচিত হতে লাগল সমুদ্রতলের বিভিন্ন প্রাণীর বৈচিত্র্যসম্ভার।কত বিচিত্র মাপ ও চেহারার রং - বেরঙের নানান সামুদ্রিক প্রাণীর দর্শন পেতে লাগলাম তার ইয়ত্তা নেই।গাইড আমাদের নিকট তাদের পরিচয় তুলে ধরতে লাগলেন।কয়েকটির মাত্র নাম মনে রাখতে পেরেছি।এদের মধ্যে প্যারট ফিস ( Parrot fish )- এর কথা না বললেই নয়।এদের মাথার উপরে ছোট্ট একটি কুঁজ মতো আছে।এরা লম্বায় প্রায় সাড়ে চার ফুট পর্যন্ত হতে পারে।এছাড়া রয়েছে লম্বা সাদা শুঁড়ওয়ালা ছোট্ট খুদে চিংড়ির দল। আছে শরীরে একাধিক  উজ্জ্বল রঙ - ওয়ালা পিকক ম্যানটিস চিংড়ি।এরা নাকি অন্য মাছেদেরও খেয়ে নেয় অর্থাৎ বিশেষভাবে আমিষাশী বা অন্য কথায়, মৎস্যভুক বা মাছখেকো চিংড়ি।এটি এবং পূর্বোক্ত _ উভয় প্রকার চিংড়িই মনুষ্যখাদ্যবাচ্য নয়। আর আছে লম্বা সরু মাথাওয়ালা মান্টা রে নামে পেটের দিকে তেকোনা পাখনাবিশিষ্ট একটি মাছ যার কানকোর নাকি চীনদেশে খুব চাহিদা।ত্বকে বড় কালো ছোপযুক্ত জায়ান্ট মোরে নামে আরো এক ধরনের বাদামী বর্ণের মাছও ওই জলে রয়েছে।শুনলাম এরা নাকি লম্বায় প্রায় দশ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।

দেখলাম আন্দামানের নিজস্ব সম্পদ বিচিত্র প্রজাতির প্রবালের অপরূপ দৃশ্যসম্ভার। ডলফিন জাহাজটি যেহেতু গভীর সমুদ্রে গমন করে ও কাচের তলদেশটি জাহাজের একেবারে নিচের অংশ_ তাই মনে হল আমরা বুঝি-বা  ওই সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যেই বসে আছি।এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।ডলফিনে ওঠবার সময়ে টিকিটের মূল্য ভার অত্যধিক প্রতিভাত হলেও হৃদয়ে সঞ্চিত দৃশ্য ও অভিজ্ঞতার ভারে সেটি অমূল্য বোধ হল।ডলফিন রাইড অতিক্রান্ত।





পুনরায় ফিরে এলাম নর্থ বে দ্বীপে। দ্বি - প্রাহরিক  আহারের পর্ব এখানে সমাধা না করলেই নয়।এখানকার ঝুপড়ি রেস্তোরাঁগুলিতে আহার্যের বৈচিত্র্য খুব বেশি নয়।তবু আহারের পর বুঝলাম প্রতিটি খাবার অতি সুস্বাদু।কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ।এসময়ে যাদের সঙ্গেই আলাপ হচ্ছে ভাগ্যক্রমে তারা প্রত্যেকেই দক্ষিণ ভারতীয় পর্যটক।আমি একটু আলাপী। দক্ষিণ ভারতে INSA India -র একটি সেমিনারে AIDS বিষয়ে বক্তব্য বিনিময় করতে গিয়ে রাস্তাঘাটে যাতায়াতের সুবাদে কষ্ট অর্জিত দু '-চারটি তামিল শব্দ সম্বলে ছিল ,তার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে কথাবার্তা বলে জানলাম যে ওরা এখানে সপরিবারে প্রায়ই আসে তাদের কর্তাদের বাণিজ্যিক প্রয়োজনে, আর কিছুটা আমাদের কাছেপিঠে দীঘায় যাত্রার মতো।

চত্বরে প্রচুর টুপি, হার - বালা,মূর্তি, শো পিস, চাবির রিং, রুমাল, ইত্যাদি বিক্রির দোকান রয়েছে।কলকাতার বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের জন্য টুকটাক কেনাকাটার ফাঁকে কথায় কথায় জানলাম এখানকার দোকানীদের বেশিরভাগ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পূর্ববঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চলগুলি থেকে আগত।কেউ কেউ পুরোপুরি চলে এসেছেন।কেউ বা বছরে এক আধবার যাতায়াত করেন। তাদের সঙ্গে স্ব-ভাষীয় কুশল বিনিময় করলাম নির্ভেজাল পথ চলতি বাংলায়।অতঃপর স্পিডবোটে চড়ে বসলাম।এবারের গন্তব্য রস আইল্যান্ড।

Ross Island: আমরা এই দ্বীপে গমনের কয়েকদিন পূর্বে এর নামকরণ হয়েছে ' নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস দ্বীপ' ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানীরা ব্রিটিশদের নিকট হতে দ্বীপটি ছিনিয়ে নেয়। জাপানীদের তৈরি বাঙ্কারটি এখনও এখানে অক্ষত অবস্থায় আছে।ব্রিটিশ আমলে ঘরবাড়ি,অফিস-কাছারির সুশোভিত সৌন্দর্য্যসহ অতি সুসজ্জিত রস আইল্যান্ডটি  ' প্রাচ্যের প্যারিস ' নামে আখ্যায়িত হয়েছিল।1941 সালের 26 জুন এক ভয়াবহ ভূ - কম্পে দ্বীপটির মাঝখান বরাবর বিশাল ফাটল ধরে। ফলতঃ বহু বাড়ি ঘরদোর ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়।এর পরপরই জাপানীদের ভয়ে সন্ত্রস্ত ব্রিটিশেরা 1942 সালে দ্বীপচ্যূত হয়।ওই বছর 23মার্চ একটি মাত্র গুলিও ব্যয় না করে জাপানীরা দ্বীপটির দখল নেয় এবং ব্রিটিশ সেনা ও পুলিশপক্ষ নির্বিবাদে জাপানীদের নিকট আত্মসমর্পন করে।ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে , প্রথমদিকে উচ্ছ্বসিত হলেও, স্থানীয় বাসিন্দাদের সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।কারণ জাপানীরা ব্রিটিশ চর সন্দেহে বেশ কিছু স্থানীয় বাসিন্দার উপর অত্যাচার আরম্ভ করে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোসিমা আর নাগাসাকিতে আমেরিকা কর্তৃক পরমাণুবোমা নিক্ষেপের অব্যবহিত পরে 1945 সালের 9 অক্টোবর তারিখে জাপানীরা তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করার পরে এই Ross Island - এর মালিকানা আবার বদল হয়।তবে আইল্যান্ডটির নামে খ্যাত দ্বীপটি ক্রমশঃ একটি ' ভুতুড়ে দ্বীপ '- এ পরিণত হয়।পরবর্তী অধ্যায়ে দ্বীপটির গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে 1979 সালের 18 এপ্রিল এটিকে সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় নৌ সেনার হাতে তুলে দেওয়া হয়।তারপর থেকে এখানে পর্যটকদের ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

26 ডিসেম্বর 2004- এ যে ভয়াবহ সুনামী হয় তাতে এই দ্বীপটি মূর্তিমান ঢাল হিসাবে কাজ করে ও নিজে পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সুনামীর ঢেউয়ের চাপ সহ্য করে পোর্ট ব্লেয়ার দ্বীপ শহরটিকে বাঁচিয়ে দিয়ে যায়।

এই রস আইল্যান্ডটি ব্রিটিশ আমলে ছিল আন্দামান ও নিকোবর অঞ্চলের রাজধানী।এর প্রাচীন নাম ' চং একি বুদ ' বদলে ব্রিটিশরা ' স্যার ড্যানিয়েল রস ' নামে এক সামুদ্রিক জরিপবিদ ( Surveyor )- এর নামে দ্বীপটির নামকরণ করেন ' রস আইল্যান্ড '।এটি পোর্টব্লেয়ার শহর থেকে সমুদ্রের মাঝখানে প্রায় আট শ' মিটার দূরত্বে অবস্থিত।1858 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা দুটি জাহাজ ভর্তি করে প্রায় 200 স্বাধীনতা সংগ্রামীকে শাস্তিস্বরূপ এই দ্বীপে আনয়ন করে ও তাদেরকে দিয়ে এই দ্বীপের জঙ্গল সাফা করে দ্বীপটিকে বাসযোগ্য করবার প্রয়াস চালায়।

একদা আন্দামান ও তার সন্নিহিত দ্বীপসমূহের প্রাচীন রাজধানী এই রস আইল্যান্ডকে স্বচক্ষে দর্শন ও পর্যবেক্ষণের পর মনে হল ইতিহাস এখানে যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে।বাড়ি - ঘর - দোর, অস্ত্রাগার,ক্লাব, জিমনাসিয়াম, ইত্যাদি সবই এখানে আছে অথচ ভগ্নদশায় এবং মনুষ্যবাসহীন অবস্থায়।

দু '- চারটি হরিণ ব্যতীত কোথাও কোনও মানুষের চিহ্ন নেই। সবই পরিত্যক্ত। ভারতীয় নৌ বাহিনীর হাতে থাকা এই দ্বীপটিতে বিকেলবেলার পরে থাকা নিষিদ্ধ।অগত্যা এখানকার পালা সাঙ্গ করে স্পিডবোটে চড়ে যথারীতি প্রত্যাবর্তন সন্ধ্যায় বর্তমান রাজধানী পোর্টব্লেয়ারে আবেরদিন জেটিতে।অতঃপর হোটেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ টি.ভি. দেখা ও চতুর্থ রাত্রের আহার সেরে শয়ন আর নিদ্রা।

পঞ্চম দিন ( 16.02 .2019 ) : এদিন ভোরে বেরিয়ে পড়লাম হ্যাভলক দ্বীপের উদ্দেশ্যে।বর্তমানে এর নাম 'স্বরাজ দ্বীপ ' ।হোটেলের গাড়ি মারফৎ সারথি মঙ্গলের কল্যাণে পৌঁছে গেলাম পোর্টব্লেয়ারের জাহাজঘাটাতে। জায়গাটি একটি ছোট শহরের বিমান বন্দরের মতো।অত্যন্ত কঠোর সিকিউরিটি চেকিং ব্যবস্থা ও তার অভ্যন্তরে খুবই আরামদায়ক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত প্রতীক্ষালয়।এখানেই প্রাতঃরাশ সারা হল।কিছুক্ষণ পর আমাদের জাহাজ  ' ভাগ্যশ্রী '- র আগমন ও প্রস্থানের সময় ঘোষণা শুরু হল।আমরা আমাদের বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে আরেক দফা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে জেটিতে উপস্থিত হলাম।

লক্ষ্য করলাম Vessel টি নামেই জাহাজ, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি অত্যাধুনিক Cruise। জলযানটির অভ্যন্তর সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। আমাদের নির্দিষ্ট সংরক্ষিত আসনখানিও খুবই আরামদায়ক ও সীল করা বাতায়ন সংলগ্ন।তাই সমুদ্রের মনোরম শোভাদর্শন অতীব সহজসাধ্য হল।Cruise টি যাত্রা শুরু করল সকাল সাতটা বেজে কুড়ি মিনিটে। জলযানটি অগ্রসর হতে থাকল_ তটভূমি ক্রমশঃ অদৃশ্য হল আর মাঝদরিয়ায় দেখলাম উপকূলের তুলনায় জল অনেক বেশি নিস্তরঙ্গ। স্মরণে এল, জেটির প্রতীক্ষালয়ে একটি প্রশাসনিক নোটিশে জানানো ছিল যে Cyclone ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে জাহাজগুলিকে গভীর সমুদ্রে রাখা হবে ও তীরের কাছাকাছি আসতে দেওয়া হবে না।তখন অবাক হলেও এখন এর মর্ম উপলব্ধি করলাম। আগে ধারণা ছিল,প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ধীবরদেরকে নৌকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করা হয়। অবশ্য এই Notice- এ বড় জলযানের কথাই বলা হয়েছে। যাই হোক, পোর্টব্লেয়ার ত্যাগ করে জাহাজ যতই হ্যাভলক অর্থাৎ স্বরাজ দ্বীপের দিকে এগোতে লাগল চোখে ধরা দিল মাঝদরিয়ায় জলের রঙ বদলের খেলা। সকালের সুন্দর আবহাওয়ায় একদিকে রোদের ঝিকিমিকি আর অন্যদিকে কখনও হালকা নীল, কখনও সবুজ রঙের জলের বহতা।

আবার আসমানী জল, কখনও বা গাঢ় নীল।ক্রমাগত জলের রঙ পরিবর্তনের বিষয়টি এত দৃশ্য মনোহর ও মজার যে তা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। অবশেষে সকাল ন 'টা বেজে পঁচিশ মিনিটে Cruise টি গন্তব্য অর্থাৎ স্বরাজ দ্বীপে এসে ভিড়ল।এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষমান গাড়িটি আমাদের নিয়ে গেল প্রায় হোম স্টে ব্যবস্থার মতো একটি হোটেলে।দ্বীপের সবচাইতে বিখ্যাত রাধানগর সৈকতটি খুবই সন্নিকটে। হোটেলটিতে জলখাবারের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আমরা সোজাসুজি চলে গেলাম সমুদ্রতটে ও তটবর্তী একটি হোটেলেই মধ্যাহ্নের আহার সংযুক্তি ঘটল।

রাধানগর বীচ: বীচটির বিশেষত্ব এর বেলাভূমির বালুকার শ্বেতশুভ্র বর্ণ।লাগোয়া সমুদ্রাংশটি খুবই শান্ত, স্বচ্ছ হালকা নীল জলযুক্ত।সাগর - স্নানের পক্ষে বড়ই সুবিধে ও আনন্দজনক।সমুদ্রের গা থেকেই উঠে গিয়েছে একটি ছোট-খাট পাহাড়, সবুজে ঢাকা।নয়নাভিরাম দৃশ্য ও পরিবেশ।এখানে সৈকতে কয়েকটি কাঠের ওয়াচ টাওয়ার ( Watch Tower ) তৈরি করা আছে। সেখানে উঠে সমুদ্রতট ও পার্শবর্তী দৃশ্যসমূহ সুন্দরভাবে অবলোকন ও উপভোগ করা সম্ভব। সমুদ্রতটের নিকটে অনেকগুলি সুদৃশ্য কটেজ (Cottage)- ও বানানো রয়েছে। রোদের হাত থেকে বাঁচতে সেখানে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়।চারপাশে এত বড় বড় গাছের সমারোহ যে এই ভরদুপুরেও কটেজগুলিতে বসতে পারলে গরমে কষ্ট হয় না। সমুদ্রতীরের নিকটে এক-একটি  বিশালকায় আস্ত গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো বসবার বেঞ্চও রয়েছে অনেকানেক।

অপরাহ্নের দিকে আরও কয়েকটি সমুদ্রতট ঘুরে আবার ফিরে এলাম রাধানগর তটে।খুবই হালকা নীল বর্ণের স্বচ্ছ ও শান্ত সাগরজলে সূর্যাস্তটি অনন্যরূপে প্রতিফলিত হল।ঠিক এই রকম অপূর্ব দৃশ্যপট মেলে না আমাদের পুরী কিম্বা দীঘার সৈকতে।সূর্যাস্তের পর এই ছোট্ট নির্জন দ্বীপে করবার মতো তেমন কিছু থাকে না।অগত্যা হোটেলে প্রত্যাবর্তন, দূরদর্শনের সামনে খানিক সময় যাপন আর যথাবিহিত নৈশাহারের পর নিদ্রাগমন।

ষষ্ঠ দিন (17.02.2019): গাড়ি অপেক্ষমান। তাই ত্বরিৎ গতিতে প্রাতরাশ পর্ব মিটিয়ে হ্যাভলক ভ্রমণের স্মৃতির আবেশকে সাথী করেই নতুন গন্তব্য নীল দ্বীপ (Neil Island) যাত্রায় প্রস্তুত।এর বর্তমান নাম হয়েছে ' শহীদ দ্বীপ '। জেটিটি বড়ই সাদামাটা ধরনের প্রতীক্ষালয়টিকে ও বড় বলা চলে না।আমরা বাইরে একটি ছাউনিযুক্ত ঘরে অপেক্ষারত। পাশে বিক্রি হচ্ছে এই দ্বীপেরই কিছু ফল ও সবজি।এখানে দেখলাম প্রচুর পরিমাণে সুপারি, বিস্তর কাঁচা পাকা আম আর অনেকানেক কামরাঙা, কলা ও নারকেল।প্রতিক্ষেত্রেই কলকাতার তুলনায় দামের পাল্লা নগণ্য। মাত্র পনেরো টাকায় একটি মস্ত বড় গোটা নারকেল সংগ্রহ করলেন আমার কর্তামশাই_ অতি শখ করে। অত বিশাল আকৃতির বুনো নারকেল আমি কস্মিনকালে কোথাও দেখিনি।কলকাতায় এনে এটি ভাঙবার পর দেখা গেল ওই নোনাজলের দ্বীপান্তরের নারকেলের জল অতীব সুমিষ্ট আর ওই নারকেলের এক - একটি মালাতে যে পরিমাণ শাঁস ছিল তাতে কলকাতার বাজারের একটি গোটা শাঁস ভর্তি বড় নারকেল হয়ে যায়।জাহাজ ছাড়ল সকল সাড়ে ন',টার সময়ে। সেই একই ধরনের বিলাসবহুল Cruise। এই সমুদ্রযাত্রায় আবার হাতছানি সেই নানারঙের জলসহ সমুদ্রের।

শহীদ দ্বীপে পৌছালাম 10.45 a.m. নাগাদ।এই জেটিটি আরও বেশি সাদামাটা , উপরন্তু ভাঙাচোরা_ সঙ্গীন।পাশে অবশ্য একটি সুন্দর বড় জেটি নির্মীয়মান,লক্ষ্য করলাম। অপেক্ষারত স্থলযানটি আমাদের নিয়ে পৌঁছে দিল ' সি রক হাইনেস ' নামক একটি হোটেলে।এটি দ্বীপের সীতা পুর সৈকতের কণ্ঠলগ্ন প্রায়।হোটেলে দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর বিকালের দিকে সীতাপুর বীচটি ঘুরে ফিরে দেখতে বেরোলাম।জলের বর্ণ হালকা সবুজ ও বেশ স্বচ্ছ।তলদেশের প্রবালগুলি বেশ স্পষ্টভাবে জলে প্রতীয় মান। তটভূমিতেও প্রচুর মৃত প্রবালের দেহাবশেষের ছড়াছড়ি। 

কিছুক্ষণ পর আমাদের যানের সারথি নিয়ে এল অন্য একটি তটে।এটি ভরতপুর বীচ।

ভরতপুর বীচ: এটি তুলনামূলক জমজমাট ও নানাবিধ সমুদ্র ক্রীড়ার বন্দোবস্তযুক্ত।যেমন নৌকাবিহারে সমুদ্রের মধ্যে কিছুটা গিয়ে স্কুবা ডাইভিং করা যায়, মাথাপিছু খরচ সাড়ে চার হাজার টাকা।সমুদ্রকুলের নিকটস্থ স্কুবা ডাইভিং - এর ক্ষেত্রে এর ধার্য্যমূল্য জন প্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা। ওয়াটার স্কুটার (JET SKY )-ও  রয়েছে। এতে চড়তে মাথাপিছু পাঁচশ'  টাকা লাগে।ফুল মাস্ক স্নর্কেলিং - এ মাথাপিছু খরচ আটশ ' টাকা ও হাফ মাস্ক স্নর্কেলিং - এর ক্ষেত্রে ওটি সাতশ ' টাকা। আর রয়েছে Glass bottom ⛵ boat । এতে  চড়তে চাইলে প্রতি জনের জন্য দেয় ছ' শ' টাকা। 

এই ভরতপুর বীচটি সামান্য ঢেউযুক্ত।একটি জায়গায় সমুদ্র এখানে কাস্তের মতো সুন্দর বাঁক নিয়েছে। পাশেই ঘন জঙ্গল।কাছাকাছি আরেকটি তটে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে নিলাম। এটির নাম লক্ষ্মনপুর বীচ। এখানে সূর্যাস্তের শোভা মনোলোভা।সন্ধ্যে গভীর হল।হোটেলে ফেরার পালা। 

সপ্তম দিন(18.02.2019):মোবাইলের অ্যালার্মে নিদ্রা ভঙ্গের পর সবুজ বনানী পরিবেষ্টিত দূষণমুক্ত পরিবেশে সুন্দর সরু একফালি পথ ধরে পদব্রজে পৌঁছলাম নীলের সূর্যোদয় খ্যাত সীতাপুর সৈকতে।একে আন্দামান - নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট একটি দ্বীপ,তায় মাঝ ফেব্রুয়ারির ঊষালগ্ন _পর্যটক প্রায় নেই বললেই চলে।কিন্তু ঘন জঙ্গলে ঘেরা সৈকতের পাশে মৃদু তরঙ্গাশ্রিত বঙ্গোপসাগরের জলের অপর দিক থেকে সূর্যের উত্থান ও হালকা পান্নাবর্ণের জলে তার অপরূপ প্রতিফলনের মায়াময় পরিবেশ বাকরুদ্ধ করে।তথাকথিত উন্নয়নের আঁচ সামান্য বলেই দ্বীপটিতে আদিম প্রকৃতির মোহময়ী রূপটি এখনও হারিয়ে যায়নি।সূর্যোদয় দেখে ফিরে এলাম হোটেলে।চটপট স্নানাহার সেরে নিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হতে না হতেই ড্রাইভার এসে তার উপস্থিতি জানাল।একবারে বেরিয়ে আরেকটি সৈকত ঘুরিয়ে সে আমাদের পৌঁছে দিল বন্দরে।

মিনিট পনেরো গাড়িতে ভ্রমণ করবার পর এলাম লক্ষ্মণপুর (২) নামক সৈকতে।এখানকার তটভূমিতে বালি কম, পাথর বেশি।এই পাথুরে সৈকতের পাশাপাশি আবাস অশান্ত সমুদ্রের।জলের রঙ ঘন সবুজ। পার্শ্ববর্তী জঙ্গলটিও বেশ ঘন ও তার একদিকে একটি ছোট টিলার ন্যায় পাহাড়ি জায়গা।এখানকার সমুদ্রে স্নান করা তো দূর অস্ত , পাশ দিয়ে হাঁটাও বেশ কষ্টসাধ্য।চতুর্দিকে পড়ে রয়েছে অসংখ্য প্রবালের দেহাবশেষ।কিন্তু সরকারি আইনে কোনও প্রবাল এখান থেকে নিয়ে যেতে গিয়ে বিমানবন্দর কিম্বা সমুদ্রবন্দরে  ধরা পড়লে কঠোর জরিমানার আজ্ঞা রয়েছে।

সৈকতে জলের সঙ্গে বেশ কিছুটা তফাৎ রেখে কোনও মতে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হতে লাগলাম।এখানে সমুদ্রের বাঁকে জঙ্গল থেকে ওল্টানো ধনুক সদৃশ বা U আকৃতির একটি প্রস্তরস্তম্ভ সমুদ্রের মাঝে গিয়ে মিশেছে।দুঃসাহসী পর্যটকদের দল এর মধ্য দিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে যাতায়াত করতে সক্ষম;এখানে এই অংশটির নাম ন্যাচারাল ব্রিজ(Natural Bridge)।ডাক নাম ' হাওড়া ব্রিজ '। হাওড়া ব্রিজের শহর থেকেই আমরা এসেছি। তাই পুলকিত হলাম নাম শুনে।জঙ্গলের গাছগুলি বিশাল মহীরুহ। একটি গাছের কথা বলি।যেমন তার কাণ্ডের বেড় তেমন তার উচ্চতা! আন্দামানের বনদপ্তর থেকে গাছটির গায়ে তার নামটি লিখে রেখেছে, 'Sea Mohwa' ( Manilkara littoralis)। গাছটির মাথা দেখতে পাওয়া দুষ্কর। সমানুপাতে নধরকান্তি তার গুঁড়ি। এ হেন দৈত্যাকার গাছ আমি জীবনে কখনও দেখিনি।

এবার ফেরার পালা।সারথি আমাদের জেটিতে পৌঁছে দিল।Criuse- এ উঠলাম বেলা এগারোটায়।দু'ঘন্টা বাদে বেলা একটা নাগাদ  সেটি এসে ভিড়ল আমাদের এই জাহাজে যাত্রারম্ভের মূল স্থানে _ সেই পোর্টব্লেয়ারে।হোটেলে প্রত্যাবর্তন। অপরাহ্নে হোটেল থেকে বেরিয়ে শহরটির এই অংশের দোকানপাটগুলি নিজেরা একটু ঘুরে দেখলাম।

এখানকার সব কিছুই কলকাতার দামেই পাওয়া যায়।এদিন রাত্রে নৈশভোজটি নিজেদের হোটেলের বদলে নিকটস্থ একটি রেস্তোরাঁয় সারলাম।পরিবেশকদের সাথে আলাপচারিতায় জ্ঞাত হলাম যে তারা Mainland অর্থাৎ মূল ভারতীয় ভূখণ্ড থেকেই এসেছে।একজন তো তার মধ্যে আবার খোদ কলকাতারই বাসিন্দা! অবশেষে পদব্রজে হোটেল অভিমুখে।পরদিন কলকাতায় ফিরে যাবার প্রতীক্ষা।

প্রত্যাবর্তন (19.02.2019):পোর্টব্লেয়ারের বীর সাভারকর বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম সকল এগারোটা নাগাদ।এখানে নিরাপত্তা পরীক্ষণ ( Security Checking )- এর কালে ঘটল আরেক বিভ্রাট! ঐতিহাসিক ভালোবাসা বিজড়িত হাতব্যাগে বন্দী নারকেলটি সাথী করে আমরা বিমানে উঠব তা কিছুতেই বরদাস্ত করতে নারাজ বিমান কর্তৃপক্ষ। অগত্যা আমি আর বাপটুস অন্যান্য মালপত্র সহ অপেক্ষমান রইলাম, আর নারকেলের মালিক দেখা করলেন ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।তাঁরা নারকেলটিকে কিছু সময় ধরে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন।হাসব,না রেগে যাব _ বুঝতে পারছি না! নারকেলটির scanning হল।অবশেষে কর্তৃপক্ষ জানালেন ,বস্তুটিকে সঙ্গের হাতব্যাগে নিয়ে যেতে না পারলেও লাগেজ ব্যাগের মধ্যে করে সেটিকে প্লেনের পেটের মধ্যে ভরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। অগত্যা ! সঙ্গের একটি ব্যাগকে আলাদা হিসেবে বুক করে নারকেলটিকে তার মধ্যে প্রবেশ করানো হল।নারকেল টিকে পূর্ণ মর্যাদাসহ মূল ভূখণ্ডে পাঠাবার তাগিদে কর্তৃ পক্ষ আমাদের বিমানের টিকিটের পশ্চাদভাগে একটি কাগজ সাঁটিয়ে দিলেন Acknowledgment হিসেবে। মনে আশঙ্কা রইল! তবে পরে দমদমের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নারকেলসহ ব্যাগটি ঠিকমত ফিরে পেয়ে আশ্বস্ত হলাম।বলাবাহুল্য, রন্ধনকার্যে পরে নারকেলটির যথাযথ সদ্ব্যবহার হয়েছিল।

পোর্টব্লেয়ার থেকে ভিস্তারা এয়ারলাইন্সের বিমান আকাশে উড়ল বেলা বারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিটে।এই যাত্রায় আমাদের বরাতে মাত্র একটি সিট জানলার পাশে পেয়েছি।নিচে সবুজে ঢাকা কত বিচিত্র আকারের নানান সব দ্বীপ।দ্বীপপুঞ্জ ত্যাগ করে ক্রমান্বয়ে উচুঁতে উঠছি... এক সময়ে মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল দ্বীপান্তরের অন্তঃপুর।শুধু কল্পনার ডানায় ভর করে আমার দর্শনে ভাসতে লাগল আন্দামানীজ,সেন্টিনেলিস,জারোয়াদের হস্ত আন্দোলনের মৃদু রেখা; আর তার সাথে কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে লাগল বাতাসে ভেসে আসা আদিবাসীদের নিজস্ব সাংকেতিক ভাষার বোল, ' টাটা বাই বাই ,/ আবার যেন দেখা পাই ' ।  রেশটি রয়ে গেছে এখনও। বিমানটি কলকাতায় বিমান বন্দরের মাটি ছুঁল সময় যন্ত্রে মাপা বেলা তিনটে বেজে পঁচিশ মিনিটে।

আমাদের এবারকার আন্দামান - নিকোবর ভ্রমণের এখানেই ইতি। এ যাত্রায় আমরা প্রধানতঃ দক্ষিণ আন্দামানেই পর্যটন করেছি।ইচ্ছে রইল পরের দ্বীপান্তর যাত্রায় মায়াবন্দর , রঙ্গত, ডিগলীপুর , ইত্যাদিসহ উত্তর ও মধ্য আন্দামান এবং নিকোবর সফরের।কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে তা জানতে জগৎটাকে দেখব বারেবার _ সাধ্যমতো পাড়ি জমাব দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে দেশে ও দেশান্তরে।সেই সূত্রে আমার ভ্রমণপিপাসু প্রিয় পাঠকবন্ধুদের পর্যটনে আমার তরফে রইল অগ্রিম আর অফুরন্ত শুভেচছা।।


🙏


 




































মন্তব্যসমূহ

  1. ✍️ইংরেজি নববর্ষ (2024 )- এর প্রাক্কালে চেনা, অচেনা সকল পাঠক বন্ধুদের জানাই শুভেচ্ছা.... অফুরান।আপনাদের সখ্যতাপূর্ণ অনুভূতি হোক চলতি পথে প্রিয়ার একমাত্র পাথেয়।
    ধন্যবাদ।
    🙏

    উত্তরমুছুন
  2. চলতি পথে প্রিয়ার সঙ্গে থাকা প্রিয় বন্ধুদের জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল।
    ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জাগো সবলা !