১৩৮- বর্ষে বাঞ্ছাকল্পদ্রুম

 


https://youtu.be/1_LnVUtzfrY?si=7mYSTwIV3_P-8h0V

ওম স্থাপকায়চ ধর্মস্য ধর্মস্বরূপিনে।                                      অবতার বরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে  নমহ।।

ঠাকুরের ধ্যান,জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিভাবের পরিপূর্ণতায় বিমুগ্ধ মানসপুত্র স্বামী বিবেকানন্দ প্রণীত গুরুপ্রণামের মন্ত্রে বন্দনা দ্বারা চেতনার আলোয় দর্শীত শ্রীরামকৃষ্ণের বাঞ্ছা কল্পদ্রুম হয়ে ওঠার ১৩৮ বর্ষ (২০২৩) এটি।

উৎসব মুখর বঙ্গ ক'দিন  আগেই মাতোয়ারা হয়েছে বড দিনের আনন্দে।ধন্য হয়েছে সাহেবী কেকের পরশে।এই খ্রিস্টান আমেজ অবশ্য আড়াল করেনি বৌদ্ধ, জৈন,শিখ, মুসলিম অথবা হিন্দুর বৈষ্ণব কিম্বা শাক্ত মতাবলম্বী ভক্তের ধর্মীয় মূল্যকে।সত্যি বলতে,কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাসিন্দারা যে কোনও ধর্ম অবলম্বিত উৎসবেই যথাসাধ্য মেতে ওঠেন অন্তর হতে।কলকাতার মনন ও মানসিক সাম্যের জোয়ার হয়তো অচিরেই প্লাবিত ও একাকার করতে চলেছে বিশ্বজুড়ে বহুবিধ ধর্মবিশ্বাসকে; যার ভিত্তিভূমি হয়তো বা রচিত হয়ে গিয়েছে বহু পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের হাত ধরেই।


২০২৩-এর ডিসেম্বরে সান্তাক্লজের দু'হাত ভরা উপঢৌকনের বহর দেখে অবধি কেন জানিনা বারম্বার স্মরণে এসে যাচ্ছিল আমাদের কল্পতরু বা কল্পদ্রুম বাবা শ্রীশ্রীপরমহংসের কথা। আরেকবার অনুভূত হল,সব ধর্মের মূলকথা শুধু নয়,চরিত্রও মূলতঃ একই। আসলে ধর্ম তো মানুষের জন্যই।তাই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে এক এবং অদ্বিতীয় 'মানব ধর্ম' প্রচলনের প্রতীক্ষায় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানবকুল।


পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে এক দরিদ্র ধর্মনিষ্ঠ রক্ষণ শীল বৈষ্ণবধর্মভুক্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে রামকৃষ্ণ পরম হংসের জন্ম।পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি।পিতৃদত্ত নাম 'গদাধর' ।


অতি অল্প বয়সেই পূরাণ,রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন তীর্থযাত্রী,সন্ন্যাসী এবং গ্রাম্য পূরাণ কথকদের কথকতা শুনে।১৮৪৩ সালে পিতৃবিয়োগের পর সংসারের দায়িত্ব পড়ল অগ্রজ রামকুমারের উপর। রাম কুমার কলকাতায় একটি সংস্কৃত টোল খোলেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন।১৮৫২ সালে দাদাকে পৌরহিত্য কর্মে সহায়তা করবার মানসেই  গদাধরের কলকাতায় পদার্পণ।


১৮৫৫ সালে কলকাতার মাহিষ্য সমাজের নিম্নবর্ণীয়া গণ্যা এক রমণী অথচ জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সেখানে প্রধান পুরোহিতের পদটি প্রাপ্ত হন।সহকারী হিসেবে প্রতিমার সাজসজ্জার ভারপ্রাপ্তির ন্যায় সুযোগ লাভ করলেন গদাধর ও তাঁর ভাগিনেয় হৃদয়রাম।১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যুতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন গদাধর।আর রানীর জামাতা ' মথুরা মোহন বিশ্বাস',মতান্তরে,অন্যতম গুরু 'তোতাপুরী' দত্ত ' রামকৃষ্ণ ' নামে আখ্যায়িত হলেন গদাধর ওরফে গদাই। 

মাকালীর পূজায় ভাব-তন্ময়তা অতি বৃদ্ধি পেলে মথুরবাবু বারবনিতার বন্দোবস্ত দ্বারা প্রলুব্ধ করে তাঁর আধ্যাত্মিক উন্মাদনা লাঘবের প্রয়াস নিলে তা ব্যর্থ হয়_দেহোপজীবিনীর মধ্যে রামকৃষ্ণ প্রত্যক্ষ করলেন দিব্য এক মাতৃমূর্তিকে!


কামারপুকুরের তিন মাইল উত্তর - পশ্চিমে জয়রামবাটী গ্রামের রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ৫ ম বর্ষীয়া বালিকা দুহিতা সারদার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন ২৩ বছর বয়স্ক রামকৃষ্ণ।১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে সারদাদেবীকে গ্রামে রেখেই কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়।১৮৬৭ সালের মে মাসের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত রইল দৈব দাম্পত্যের বিরহ পর্যায়।ঠাকুর মন্দিরের কাজে জুড়লেন পুনরায়।কিন্তু উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক উত্তেজনা রোখে কার সাধ্যি!


ব্রাহ্মণদের জাত্যাভিমান দূর করতে শুরু করলেন নিম্নবর্ণীয় দের হাতে খাদ্যগ্রহণ,আর ভৃত্য ও সাফাইকর্মীদের ন্যায় অন্ত্যজ পারিয়াদের প্রতি সেবাকর্ম। স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাকে মাটির ঢেলার সঙ্গে মিশিয়ে বলে উঠলেন, ' টাকা মাটি, মাটি টাকা '।আর অর্থকে লোষ্ট্রজ্ঞানে গঙ্গায় নিক্ষেপে রত হলেন। জনগণের আর দোষ কি! সকলে তাকে বদ্ধ 'পাগল ' জ্ঞান করতে লাগলেন। হাল ছাড়তে বসলেন চিকিৎসকের দল।

ভৈরবী ব্রাহ্মণী, তোতাপুরী ও গোবিন্দ রায়ের নিকট হতে আহরণ করলেন অদ্বৈত বেদান্ত,ভক্তি ও তন্ত্রদর্শনের জ্ঞান।


প্রথামত সতেরো - আঠেরো বছর বয়সে সারদার পতিগৃহে যাত্রা নিষ্পন্ন হল।গুজব শোনা গেল,স্বামী তার ' পাগল '; আরেকটি গুজবের বক্তব্য, পতিদেব নাকি বিশিষ্ট সাধকে পরিণত হয়েছেন।অতঃপর পতির নিকট পৌঁছাতে 'রামকৃষ্ণ ' দ্বারা মাতৃজ্ঞানে পূজিতা হলেন ' মা '।এতদসত্ত্বেও পতি দেবতার কায়ার ছায়াসম ধর্মপালিকা হয়ে রইলেন।ষড়রিপু র তাড়নায় স্থানত্যাগ করলেন না।


শৈশবে গদাধর সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গলাভ করতেন এবং তাদের সাজসজ্জার অনুকরণে সাজতেনও।তাঁর জীবনীতে প্রাপ্ত,শিবরাত্রিতে প্রতিবেশীগৃহে শিবযাত্রাপালার অনুষ্ঠানে শিব - চরিত্রে অভিনেতা অসুস্থ থাকায় প্রতিবেশীদের অনুরোধে বালক গদাধরকে কোমরে ব্যাঘ্রচর্মবস্ত্র, মস্তকে জটাভার, গায়ে ভস্মপ্রলেপ, কণ্ঠে আলিঙ্গিত নকল সর্প ও ডম্বরুসহ হাজির হতে হয় আসরে।সেখানে তিনি নাকি শিবের ভাবে বিভোর হয়ে পড়েন বাস্তবেই!


সাধন-সংস্কৃতির দীর্ঘ অধ্যায়ে বিভিন্ন ধর্মাদর্শের সাধনকালীন তাঁর আকুতি ও সিদ্ধিলাভের প্রয়াস প্রসঙ্গটি ব্যঞ্জনাবহ।ঠাকুরের ইসলাম সাধনা প্রসঙ্গে শ্রীযুক্ত শশীভূষণ ঘোষ লিখেছেন, " আল্লামন্ত্র সাধন করিবার সময় তিনি মুসলমানের মত বেশ পরিধান,পেঁয়াজ - রসুন সংযুক্ত অন্ন আহার এবং মসজিদে যাইয়া নমাজ প্রভৃতি নিয়ম পালন করিতেন।" ইসলাম ধর্মমতে নমাজকালে বস্ত্র দ্বারা দেহ ও টুপি দ্বারা মস্তক আবৃত রাখবার নিয়ম।ঠাকুরের কথায়, " ওই সময়ে আল্লামন্ত্র জপ করিতাম,মুসলমানদিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম; ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম।" লোক শ্রুতি,সে সময়ে তিনি নাকি কাপড়কে ভাঁজ করে লুঙ্গির ন্যায় পরেছিলেন,গায়ে রেখেছিলেন কৃষ্ণ বর্ণের হাত পর্যন্ত ঢোলা জামা অর্থাৎ জোব্বা এবং মাথায় সাদা টুপি।এই জোব্বা ও টুপি সরবরাহ করেছিলেন দক্ষিণেশ্বর গাজীপীর আস্তানার মাতোয়ালী ফকির ওস্তাগর।


লীলাপ্রসঙ্গকারের ভাষায়, " মধুর ভাবসাধনে প্রবৃত্ত হইয়া ঠাকুর স্ত্রীজনোচিত বেশভূষা ধারণের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং পরমভক্ত মথুরামোহন তাঁহার ঐরূপ অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া কখন বহুমূল্য শাড়ি এবং কখন ঘাগড়া,ওড়না, কাঁচুলি প্রভৃতির দ্বারা তাঁহাকে সজ্জিত করিয়া সুখী হইয়াছিলেন।আবার বাবার রমণীবেশ সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ করিবার জন্য শ্রীযুক্ত মথুর চাঁচর কেশপাশ (পরচুল)  এবং এক স্যুট স্বর্ণালংকারেও তাঁহাকে ভূষিত করিয়াছিলেন ।"


সনাতন হিন্দুধর্মকে রক্ষার জন্যে একদা ঈশ্বরের আবির্ভাব হয়েছিল শ্রীচৈতন্যরূপে।খ্রিস্টান ধর্মের অপপ্রয়োগজনিত ঋণাত্মক শক্তিবৃদ্ধিতে তৎকালীন উচ্চশিক্ষিত হিন্দুরা সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতি আস্থাহীন হলে রাজা রামমোহন, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ ধর্মসংস্কারকগণও সঠিক পথের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ধর্ম সংস্থাপনের সঠিক নির্দেশ পাওয়া গেল ভক্তরূপী ভগবান,নিরক্ষর মূর্খরূপে পরিগণিত শ্রী রামকৃষ্ণ কন্ঠে; দিলেন সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা _' যত মত, তত পথ '।


উনিশ শতকের পাশ্চাত্য নব্য শিক্ষা - সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের ব্যবহারিক জীবনধারায় সংযুক্ত হয়ে পড়ে ' গুড মর্নিং ', ' গড ব্লেস ইউ ' কিম্বা ' থ্যাংক ইউ ' - এর ন্যায় সাহেবী শিষ্টাচারের প্রবল সংক্রমণ।সনাতন প্রণামের ঐতিহাসিক রীতিটি ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে যেতে কুসংস্কারে পর্যবসিত প্রায়। অতীব রক্ষণশীল কতিপয় বাঙালী - সাব শুধুমাত্র ডান হাতের তর্জনীটি একবার কপালে  ঠেকাচ্ছেন; রসিক ঠাকুরের ভাষায় ' কুড়ুলে নমস্কার '।


বলাবাহুল্য হলেও বলি, কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের সূচনায় মুখোমুখি দন্ডায়মান দুই যুযুধান পক্ষ, কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব রথ হতে অবতরণ করে কুরুপক্ষীয় ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রমুখ সম্মানভাজনের নিকট পৌঁছে বিনম্র প্রণাম নিবেদন করায় প্রতিপক্ষ গুরুজনদের বিরূপতা রূপান্তরিত হয় আশীর্বাদক বচনে। রণক্ষেত্রটি হয়ে ওঠে ধর্মক্ষেত্র; আর দলের একজনের শিষ্টাচারবোধ পুরো পাণ্ডবপক্ষের চারিত্রিক মহিমাবর্ধন ঘটায় বহুগুণে।

রামচন্দ্র দত্তের প্রাসঙ্গিক উক্তিটি স্মরণীয়_ " রামকৃষ্ণের গুরুগিরি ছিল না।তিনি যেন গুরুগিরি চূর্ণ করিতে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তাঁহাকে প্রণাম করিবার আগে তিনি নমস্কার করিয়া ফেলিতেন।" গিরিশচন্দ্র একবার মন্তব্য করেন, " রাম অবতারে ধনুর্বাণ নিয়ে জগৎ জয় হয়েছিল ।কৃষ্ণ অবতারে জয় হয়েছিল বংশী ধ্বনিতে।আর রামকৃষ্ণ অবতারে জয় হবে প্রণাম অস্ত্রে।" 


সারদা মা ঠাকুরের প্রথম ত্যাগী সন্ন্যাসী ভক্ত। এছাড়া যেসব ত্যাগী সন্তান সৈনিক - সন্ন্যাসীরূপে তাঁর মহাভাবের ধারক,বাহক ও প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন, সেই ষোড়শ ব্যক্তিত্বই ছিলেন এই অবতার পুরুষের পার্ষদ।এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত)। স্বামীজির যে ভাবনাটি আজকের দুনিয়া থেকে সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত কায়েমী ও গুরুদেবের মানবর্ধক সেটি হল, " জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভরশীল হতে শেখানো না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য্য ভারতের একটা ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।আমাদের কাজ হওয়া উচিত প্রধানতঃ শিক্ষাদান, চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ সাধনের জন্য শিক্ষাবিস্তার।" বাকি পার্ষদেরা হলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ ( রাখালচন্দ্র ঘোষ),স্বামী শিবানন্দ (তারাকনাথ ঘোষাল),স্বামী অখন্ডানন্দ (গঙ্গাধর চট্টোপাধ্যায়),স্বামী বিজ্ঞানানন্দ(হরি প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়),স্বামী অভেদানন্দ (কালীপ্রসাদ চন্দ্র), স্বামী সারদানন্দ ( শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী), স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ( শশীভূষণ চক্রবর্তী), স্বামী যোগানন্দ ( যোগীন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী), স্বামী নিরঞ্জনানন্দ ( নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ ), স্বামী প্রেমানন্দ (বাবুরাম ঘোষ),স্বামী অদ্ভুতানন্দ (লাটু মহারাজ ), স্বামী অদ্বৈতানন্দ (গোপালচন্দ্র ঘোষ),স্বামী তুরীয়ানন্দ ( হরিনাথ চট্টোপাধ্যায়),স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ (সারদাপ্রসন্ন মিত্র) এবং  স্বামী সুবোধানন্দ ( সুবোধচন্দ্র ঘোষ )।


এতদ্ব্যতীত , শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবপ্রচারে বিশেষভাবে ব্রতী গৃহী ভক্তেরা হলেন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ভক্ত প্রবর রামচন্দ্র দত্ত,সুরেশচন্দ্র দত্ত, কথামৃতকার মহেন্দ্র নাথ দত্ত প্রমুখ।


১৮৮৫ সালের শেষের দিকের কথা। ঠাকুরের শরীরখানি প্রায়শঃই খারাপ যাচ্ছে।এক কন্ঠে দুরারোগ্য মারণ রোগ ক্যান্সার, তায় মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা পড়েছে সে বছর। ঠাকুরকে কাশীপুরে শ্রীযুক্ত গোপাল ঘোষ মহাশয়ের বিস্তৃত পরিসর খোলামেলা বাগানবাটিতে নিয়ে এসে রাখা হয়েছে চিকিৎসার স্বার্থে। চতুস্পার্শ বাগান ও গাছপালা বেষ্টিত বাড়িটি ঠাকুরের মনে ধরেছে।এই বাড়িতেই দ্বিতলের একটি কক্ষে চলেছে তাঁর সেবা - যত্ন।ঘরটি সর্বদা ঘিরে রাখেন তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানেরা। নিরঞ্জন মহারাজের নজর এড়িয়ে সেখানে একটি মক্ষীকার প্রবেশও অসম্ভব।চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার নির্দেশনামায় জানিয়েছেন যে কথা বললেই ঠাকুরের অসুখ বৃদ্ধি পাবে। তবু ঐ শরীরেও ভক্তদের আবদার উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি যে কথা বলেই চলেছেন অনর্গল। ফলতঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে কণ্ঠের রোগ ; তাই এ হেন সাবধানতা।


বাড়িটির একতলার একটি কক্ষে বসবাস করছেন শ্রীমা  ; আর সকলের অলক্ষ্যে নিরলস পাতিব্রত্যের সেবাধর্ম পালন করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির প্রতি সদা জাগ্রত প্রহরা তার।ভক্তদের সর্বক্ষণের ওঠানামার পথে উক্ত খন্ড বাক্যাংশ অনুসরণই ঠাকুরের খবরাখবর জানবার একমাত্র সূত্র তার। দিনমানে অত ভক্তের ভিড়ে তার যে ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হবার জো নেই! ডিসেম্বরের শেষের দিকে ঠাকুর বিছানা ছাড়তে অপারগ একদম। মানসপুত্র নরেনকে নানান উপদেশ দ্বারা সমৃদ্ধ করছেন আর নিজের অবর্তমানে এই সুযোগ্য সন্তানের হস্তে ন্যস্ত করতে চাইছেন সন্ন্যাসী সংঘের সর্বময় দায়িত্ব।লাটু মহারাজও তানে সেবায় নিরত। ঠাকুর খাদ্য গলাধঃকরণ করতে পারছেন না বললেই চলে। অবোধ ভক্ত নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ ব্যতীত প্রায় সকলেরই বোধগম্য যে ক্রমক্ষীয়মান কন্ঠস্বরযুক্ত ঠাকুরের মর্ত্যত্যাগের সময় আসন্ন ( প্রায় )।


১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি। শ্রীমাঃ পূজারতা। বেলা তিনটে নাগাদ লাল পেড়ে ধুতি,গায়ে সবুজ রঙের জামা ( কোট ), কান ঢাকা টুপি,পায় মোজা ও বার্নিশ করা চটি পরিহিত ক্ষীণতনু জ্যোতির্ময়, লাবণ্যযুক্ত, কিঞ্চিৎ সুস্থবোধকারী ঠাকুর স্বয়ং ছায়ামূর্তিসম সিঁড়ি বেয়ে অবতরণ করে বাগানের পথ পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছেন ভক্তগণের দিকে।উপরে ঠাকুরের কক্ষের বাতায়নপথে তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানেরা এ দৃশ্য অবলোকন করলেন, আর ভাবলেন,ইত্যবসরে তাঁর বালিশ,বিছানা একটু রোদ্দুরে দেওয়া যাবে।তাই তারা আর নীচে নামলেন না।( এখানে বর্ণিত সবুজ কোটটি রক্ষিত আছে বেলুড় মঠের ' শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ শালা'-য়)


গৃহী ভক্তদের ভিড়ে এসে সর্বাগ্রে অবোধ গিরিশকে দেখতে পেয়ে শুধোলেন, " গিরিশ, তুমি আর মধ্যে ( নিজেকে নির্দেশ করে ( কি এমন দেখেছ যে লোকজনকে যা তা বলে বেড়াচ্ছ?" প্রত্যুত্তরে গিরিশ বললেন," ব্যাস বাল্মীকি যার ইয়ত্তা করতে পারেননি,আমি আর তার কি বলব?" সমবেত জনতার ' সাধু ' ' সাধু ' রব,ঠাকুর খুশি,এতকাল আপনার স্বরূপ লুকিয়ে শেষমেষ গিরিশের মুখ দ্বারা তা ব্যক্ত করিয়ে নিলেন।


ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে মৃত্যুর মাসকয়েক পূর্বের এদিনটিতেই ভক্তদের ইচ্ছেপূরণে কল্পতরু বা কল্পদ্রুম হন রামকৃষ্ণ পরমহংস।প্রিয় শিষ্য গিরিশের হাত ধরে ভক্তদের মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষকে শিখিয়েছিলেন জীবনদর্শন। সবাইকে মৃত্যুর অনিবার্যতা শিখিয়ে প্রস্তুত করেছিলেন নিজের মৃত্যুকে বুঝেপড়ে নেবার জন্য।মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, " মৃত্যুকে সর্বদা মনে রাখবে।মরবার পর আর কিছুই থাকবে না।এখানে কতকগুলি কর্ম করতে আসা।মৃত্যু সময়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া ভাল। শেষ বয়সে নির্জনে গিয়া কেবল ঈশ্বরচিন্তা ও তাঁর নাম করা। শরীরটা দুদিনের জন্য; তিনিই সত্য,শরীর এই আছে এই নাই।"


নাট্যকার গিরিশচন্দ্রকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ' তোমার কি মনে হয়,আমি কে?' গিরিশের বিশ্বাসমাফিক রামকৃষ্ণ ' মানবকল্যাণের জন্য মর্ত্যে অবতীর্ণ ঈশ্বরের অবতার '।এরপর তিনি সমাধিস্থ হয়ে প্রত্যেক শিষ্যকে স্পর্শ করেন।অনুগামীদের নিকট জানা যায় যে তাঁর স্পর্শে সেদিন প্রত্যেকের অদ্ভুত কিছু আধ্যাত্মিক অনুভূতি প্রাপ্তি ঘটে। অন্যতম শিষ্য রামচন্দ্র দত্তের ব্যাখ্যানুসারে,সেদিন ঠাকুর হিন্দু পুরাণে বর্ণিত বাঞ্ছা বা ইচ্ছেপূরণের গাছ,তরু বা দ্রুমে পরিণত হয়েছিলেন। তিনিই এ দিনটির নামকরণ করেন ' কল্পতরু দিবস '। পরে এটিই খ্যাত হয় ' কল্পতরু উৎসব ' নামে।আশ্চর্যের বিষয়,এদিন ঠাকুরের গৃহস্থ শিষ্যরাই তাঁর সন্নিকটে উপস্থিত ছিলেন, সন্ন্যাসী ভক্তেরা নয়!


সমবেত ভক্তমন্ডলীকে বর প্রার্থনা করে নিতে বললেন ঠাকুর।কেউ অর্থ,কেউ মোক্ষ বা অন্য কিছু চাইলেন। বাঞ্ছা কল্পতরু বলে উঠলেন, " তোমাদের চৈতন্য হোক"। এদিন ঠাকুরের তাঁর অনুগামীদের নিকট নিজেকে ' অবতার ' বলে ঘোষণা করলেন। অকাতরে করুণা বিতরণের পর ঠাকুর তাঁর নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে চিরতরে শয্যা গ্রহণ করলেন, সে শয্যা ইহজীবনে একটি বারের জন্যেও ত্যাগ করেন নি , জনশ্রুতি।


তাঁর জীবদ্দশায় শুরু হওয়া ' কল্পতরু ' উৎসব পালিত হয়ে চলেছে মৃত্যু পরবর্তী প্রতিটি বর্ষেই। কাশীপুর উদ্যানবাটিতে জীবনের শেষ কটি দিন কাটানির কারণে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের এই শাখাকেন্দ্রে উৎসবটি পালিত হয় ধুমধাম করে মহাসমারোহে ।


নীলকন্ঠ শিব যেমন অকাতরে অমৃত বিলিয়ে নিজ কন্ঠে ধারণ করেছিলেন কালকুট, অনুরূপে ঠাকুরও তাঁর দিব্য অঙ্গে গ্রহণ করলেন মানুষের যত পাপ,আর প্রতিদানে অমৃত বিলোলেন অকাতরে।তাঁর মতে, " সন্ন্যাসীরা তো য় কিন্তু সংসারে থেকে যারা ঈশ্বরকে ডাকে তারাই বীরভক্ত।" তাঁর কথায়, ' জলে নৌকা থাকুক ক্ষতি নেই।নৌকার ভিতর যেন জল বা ঢোকে। তাহলে নৌকা ডুবে যাবে। সাধক সংসারে থাকুক ক্ষতি নেই। সাধকের মনে যেন সংসার-ভাব না আসে।'


ঠাকুরের পার্ষদ গণের পাঁচ জন__বিবেকানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, যোগানন্দ, প্রেমানন্দ ও নিরঞ্জনানন্দ ঈশ্বরকোটীরূপে রাম ও কৃষ্ণের জীবনকে অবলম্বনব করে যেন উঠে এসেছেন পূরাণ মহাকাব্যের পাতা থেকে।


ঠাকুরের প্রয়াণের পর বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী শিষ্যদের নিয়ে বরানগরে একটি পোড়োবাড়িতে ওঠেন এবং গৃহী শিষ্যদের অর্থ সাহায্যে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠা করেন।শুরু হয় রামকৃষ্ণ মিশনের পথ চলা।ঠাকুরের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।১৮৯৭ সালে স্থাপিত ' রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ' হল স্বামীজি স্থাপিত প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির একটি। একাধিক শাখাকেন্দ্র মারফৎ এটি স্বাস্থ্যরক্ষা,প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা ও ত্রাণকার্য, গ্রাম ব্যবস্থাপনা,আদিবাসী কল্যাণ,প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা বিস্তারের কাজ করে চলেছে।


রামকৃষ্ণ নামাঙ্কিত আরও কতিপয় প্রতিষ্ঠানও বিদ্যমান।১৯২৩ সালে স্বামী আভেদানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন ' শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ( বেদান্ত সোসাইটি )',১৯২৯ সালে স্থাপিত হয়     'রামকৃষ্ণ সারদা মঠ '।১৯৫৯ সালে রামকৃষ্ণ  মঠ ও মিশনের ভগিনী সংগঠন হিসেবে স্থাপিত হয় ' শ্রী সারদা মঠ ' ও ' রামকৃষ্ণ সারদা মিশন '।১৯৭৬ সালে স্বামী নিত্যানন্দ স্থাপন করেন ' রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন '।


২০১০ সালের ১ লা জানুয়ারি পূর্ব রেল দক্ষিণেশ্বরের তীর্থ যাত্রীদের জন্য দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে।এই উপলক্ষ্যে দরিদ্র্যদের দাতব্য চিকিৎসা ও কম্বল বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়।এ সমস্ত কর্মকান্ড সাবলীলভাবে বিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অজস্র ধন্যবাদ প্রাপ্য রানি রাসমণির সুযোগ্য উত্তরসুরী শ্রীযুক্ত কুশল চৌধুরী মহাশয় ও অবশ্যই সাথী ট্রাস্টি সদস্যবর্গের।


কোভিড কালে সাধারণ কার্যক্রম ব্যাহত হলেও পূর্বোক্ত প্রতি টি প্রতিষ্ঠান ঠাকুরের আশীর্বাদ বিলিয়ে দিতে তৎপর ও সফল ছিল আর্তজনের পরিষেবায়।বিদগ্ধ ফরাসী রোমা রোলাঁ রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে যা বলেন সেটি বাঙলা তর্জমায়,"ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর পাঁচহাজার বৎসরব্যাপী সাধনার ফলস্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন যেন সহস্র সুরের সমন্বিত ঐকতান।"


অলৌকিক আকর্ষণযুক্ত এই যোগীপুরুষ মাদুলী - কবচ, কোষ্ঠীবিচার ব্যতিরেকেই নিরাকারবাদী কেশবসেনকে সাকারবাদী ভক্তে,মাতাল গিরিশ ঘোষকে মহাত্মায় রূপান্তরিত করেন। মথুরামোহন বিশ্বাসের দৃষ্টি অর্থ হতে পরমার্থে,চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকারকে আধ্যাত্মিক জগতে, সমাজে অনাদৃতা নটী বিনোদিনীকে সাধিকায়,গুরু তোরাপুরীকে  নিজ শিষ্যের মর্যাদায় ,সামান্য খ্যাত নরেনকে স্বামী বিবেকানন্দে ও মূর্খ সেবক লেটোকে ব্রহ্মজ্ঞানী লাটু মহারাজে উন্নীত করেন। সর্বোপরি, অতি সাধারণ স্বভাব ও আচরণ সমন্বিতা পত্নী সারদাকে জগৎজননী স্বীকৃতির অধিকারিণী করে তোলেন।এ সকলই বস্তুতপক্ষে তাঁর আদি ও অকৃত্রিম লীলা বৈ নয়!


ঠাকুরের সর্বাধিক জনপ্রিয় অমৃতবাণীটি হল, আমার ধর্ম ঠিক আর অপরের ধর্ম ভুল,এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বৈ দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে।কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লাহ,কেউ বলে কৃষ্ণ,কেউ বলে শিব,কেউ বলে ব্রহ্ম।যেমন পুকুরে জল আছে,এক ঘাটের লোক বলছে ওয়াটার,আর এক ঘাটের লোক বলছে পানি,হিন্দু বলছে জল, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক।মত _ পথ।এক-একটি ধর্মের মত এক - একটি পথ,ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়।যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।


পরিশেষে এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ও দার্শনিক রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায় অমৃতজালে বন্দি করি ১৩৮ বর্ষে পদার্পিত বাঞ্ছাকল্পদ্রুম,অমৃতপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে_

" বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা,                                         ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা;                                  তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে                                     নতুন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;                                           দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি                                      সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।।"

********************************************









🙏🙏🙏🙏🙏🪔🙏🙏🙏🙏🙏

🍁🍁🍁🍁🍁🙏🍁🍁🍁🍁🍁

মন্তব্যসমূহ

  1. জয় শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব🙏

    উত্তরমুছুন
  2. ✍️প্রিয় বন্ধুদের গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক চলতি পথে প্রিয়া রচিত ১৩৮ - বর্ষে বাঞ্ছা‌কল্পদ্রুমের সৌষ্ঠব।🙏

    উত্তরমুছুন
  3. " যেইভাবে ধূলোপূর্ণ আয়নার উপর সূর্যের আলোর প্রতিবিম্ব পড়ে না,ঠিক সেইভাবে মলিন মনে ঈশ্বরের প্রকাশের প্রতিবিম্বও পড়া সম্ভব নয়।"

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

জনারণ্যে বাংলা গানের পাখি

আদুরে রাঙা পাথুরেডাঙায়

নজরুল জয়ন্তী