নজরুল জয়ন্তী

 https://photos.google.com/photo/AF1QipMr1trPuFtXVcDWi-8W7PSqq899Xr2I0rZhqEJD

শিরোনামঃ শ্রদ্ধাঞ্জলি

" ওই শুনি যেন চরণধ্বনি রে..."

        __ বিশ্বকবির ভাষায় শ্রদ্ধাপূর্ণ আহ্বান জানাই দুখুমিঞার বীরত্বে ভরা প্রতিভাময় বঙ্গ প্রেমী সত্ত্বাকে।

তিনিই আমাদের কাজী নজরুল।১৮৯৯ সালের ২৪ মে তারিখে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম।পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন।

অভাব - অনটন ছিল তাঁর আশৈশবের নিত্য সঙ্গী।নিজের অবস্থাকে সম্মান জ্ঞাপনের মহত্ব ও দর্শন তাঁর লেখায় চিত্রিত __ ' হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান ...'।শৈশব হতেই ছিলেন লেটো দলের বাদক।রুটির দোকানের শ্রমিকরূপে পেরিয়ে গেছে শৈশব আর কৈশোরের নিষ্পাপ বয়সগুলি।পরবর্তীতে কাজ করেছেন সৈনিক হিসেবে।সাংবাদিকতাও করেছেন দুখু মিঞা।কাজ করেছেন এইচ এম ভি ও কলকাতা বেতারে।ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছেন।পাশাপাশি সাহিত্য সাধনা আর গীতি সৃষ্টি তো ছিলই।শাসকের কো পানল অথবা কারারুদ্ধতা নত করতে পারেনি নজরুলের উচ্চ শির।

বাংলা সাহিত্যে ' বিদ্রোহী কবি ' হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার,সাংবাদিক,চলচ্চিত্রকার,গায়ক ও অভিনেতা। বৈচিত্র্যময় নানান রাগ - রাগিণীর সম্ভারে সজ্জিত করে তুলেছেন বাংলা সঙ্গীত জগৎটিকে।

বাঙালিকে উদ্দীপ্ত ও জাগ্রত করতে রচিত ১৩৯ -পংক্তির 'বিদ্রোহী'কবিতাটি স্মৃতিচারণ কারিণীর ঘরের অতি সন্নিকটে কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে লিখতে শুরু করেন সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত বাইশ বছরের যুবক নজরুল।সেটি ছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের রাত।

কালজয়ী কবিতাটির কয়েক লাইন উল্লেখ না করলেই নয়_" বল বীর_/ বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।/ বল বীর_......"।কবিতাটির প্রথম শ্রোতাবন্ধু মুজফ্ফর আহমেদ, আর প্রথম প্রকাশ সাপ্তাহিক " বিজলী " পত্রিকায়।বিশ্লেষকদের অভিমত, রবীন্দ্র জমানার সাহিত্য থেকে বেরিয়ে এটি নতুন এক সাহিত্যধারার সূচনা বৈ নয়।একশো দুই পেরিয়ে তিনও অতিবাহিত,আজও ফুরোয়নি তার আবেদন, রয়ে গিয়েছে সেই সেদিনের মতোই!

বাংলাদেশের জাতীয় কবি তিনি।কবি; তবু সৈনিকের বেশে রণক্ষেত্রে সামিল! হাতে ছিল অস্ত্র,বুক পকেটে কবিতার খাতা।তাঁর কবিতার উজ্জীবনী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ সৈনিকের দল ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশমাতৃকার রক্ষাকর্মে! দেশভাগের পরে মর্মাহত বঙ্গবাসীর প্রতিনিধিরূপে অন্নদা শঙ্করের লেখায় ধরা পড়ে,' ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল '।

' বাংলা গানের  ইতিবৃত্ত ' নামক গ্রন্থে শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার রায় বলেন, " নজরুলের সঙ্গীত রচনার উৎস বর্ণনা যেমনি হউক, প্রতিভা ধারণ করেই নজরুল পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তা না হলে রচনা করা সম্ভব হতো না ৩,৫০০- এর বেশি সঙ্গীত।" তাঁর ' চল চল চল, ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল ' বাংলাদেশের রণসঙ্গীত।

হুগলী জেলে বাসকালীন সকল অত্যাচারের প্রতিবাদ ব্যঙ্গ শলাকায় ঝলসে উঠেছে ' এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল ' গানটির মধ্য দিয়ে।কবির ' বিষের বাঁশি ' তে শ্রাবণ,১৩৩১ সংখ্যায় এটি স্থান পেয়েছে।

অন্য একটি বিখ্যাত গান, ' কারার ঐ লৌহ কপাট '। অসহযোগ আন্দোলন তখন নামেই নিরুপদ্রব, কাজে অগ্নিগর্ভ।হাজারো মুক্তিকামী মানুষের বাধ্যতামূলক কারাবরণে বন্দীশালা গুলি পরিপূর্ণ।এমতাবস্থায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ' বাংলা কথা ' পত্রিকার জন্য লেখার অনুরোধ আসলে ১৯২১ সালে  ' ভাঙার গান ' শিরোনামে দুখু মিয়া রচনা করে ফেললেন এই গান।

যুগান্তরের ছাত্রশক্তিকে উদ্দীপ্ত করতে অনস্বীকার্য ' আমরা শক্তি,আমরা বল,আমরা ছাত্রদল ' গানটি কৃষ্ণনগর ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীতরূপে রচনা করেন ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে তারিখে।ছাত্রদলের এই গানটি কীর্তন-বাউল সুরের ধারায় প্রবাহিত।এটি ' সর্বহারা ' ও ' সঞ্চিতা ' য় আছে।

১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় হিন্দু মুসলিম ভাইদের অন্তর্দ্বন্দ্ব দাঙ্গায় পর্যবসিত হলে কৃষ্ণনগরে বসবাসকারী বিচলিত নজরুল হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির তাৎপর্যকে বিষয়বস্তু করে কংগ্রেস সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত রচনা করলেন।সংগীতটি ভীষণ প্রিয়__ বঙ্গবাসীর অন্তরের বাণী: " দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।..." সভায় উদ্বোধনী সংগীতটি তিনি নিজ কণ্ঠেই গেয়ে উঠলেন!

তাঁর গানে দেশাত্মবোধ ছাড়াও ধরা পড়ে অনেক নতুনত্ব,রসবোধ,আরও হরেক বৈচিত্র্য।তাঁর জীবন বৈচিত্র্য আসলে তাঁকে টেনে এনেছে নানাবিধ ঘরানার মাটিতে। তাই কোনও ওস্তাদের কাছে তালিম না নিয়েও সৃষ্টি করে গিয়েছেন নতুন এক অধ্যায় যা দেশ ,কাল ছাপিয়ে অনন্ত রাগের অভিমুখী।

পল্লীগীতি ভাওয়াইয়ার জন্য খ্যাত কোচবিহার ছিল আব্বাসউদ্দিন আহমেদের জন্মভূমি।একদিন রিহার্সাল ঘরে বসে আব্বাসউদ্দিন আপন মনে গাইছিলেন, ' নদীর নাম সই কচুয়া / মাছ মারে মাছুয়া/ মুই নারী দিচোন ছ্যাকা পাড়া।' সুরমুগ্ধ কবি আব্বাসউদ্দিনের নিকট বারম্বার শুনতে চান গানটি।রচিত হল  ভাওয়াইয়া সুরে নজরুলের প্রথম গান ' নদীর  নাম সই অঞ্জনা '।কবির  'বন - গীতি ' গ্রন্থে স্থান লাভ করে গানটি।

 গ্রামোফোন কোম্পানির আড্ডায় কয়েকজন শিল্পীর মধ্যে কথোপকথন চলছিল। প্রশ্ন উঠল যে এক লাখ টাকা লটারীতে প্রাপ্ত হলে কে কার প্রিয়াকে কিভাবে সাজাবে! ওয়াসেন মোল্লা থেকে সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত চললেন অনেকে।খাতা ও কলম নিয়ে কবি তাঁর প্রিয়াকে রচন শৈলী দ্বারা সজ্জিত করে তুললেন, ' মোর প্রিয়া হবে এসো রানী '...।

তাঁর রচনায় হিন্দু দেবদেবীর প্রকাশ্য ছায়া তাঁকে কারাবরণেও বাধ্য করে।আসলে তিনি যে বিজ্ঞানসম্মত মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।কবি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন হিন্দু পরিবারের মেয়ের সঙ্গে।এতদ্ব্যতীত সন্তানদের নামকরণে জাতধর্মের সাম্যরক্ষা করেছেন সুচারুরূপে।তাদের নাম রেখেছেন কৃষ্ণ মুহাম্মদ,অরিন্দম খালেদ,কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।

১৯২২ সালের ১২- ই আগস্ট 'ধূমকেতু পত্রিকা ' প্রকাশ ছাড়াও নজরুল 'ধূপছায়া ' নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ' জামাইষষ্ঠী ' ও শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত 'গৃহদাহ '- এর সুরকার ছিলেন তিনি।

১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার ' জগত্তারিণী স্বর্ণপদক ' দ্বারা সম্মানিত করা হয় তাঁকে।তাঁর সক্রিয় জীবনের অবসান ঘটে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে।১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় শিশুদের জন্য তাঁর লেখা নাটিকা, ' পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে '।সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ   (নাটক ) ' শিল্পী '।

১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের উদ্যোগে কবিকে সপরিবারে ঢাকায় আনয়ন করে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা।

১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ' ডি - লিট ' উপাধিতে ভূষিত করে।১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে নাগরিকত্ব দান করে। একই বছরের ২১ শে ফেব্রুয়ারি একুশে পদকের মর্যাদা জ্ঞাপন করা হয় তাঁকে।

একটি প্রিয় ও উল্লেখযোগ্য কথার অনুভূতি বিনিময় না করলেই নয়__বয়সে বিস্তর ফারাকযুক্ত আমার শ্রদ্ধেয় দাদাভাই স্বর্গীয় শ্রী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে শ্যামাসঙ্গীত শিখিয়েছিলেন মুসলিম বংশোদ্ভুত কাজী নজরুল ইসলাম।পরবর্তীতে কালীপুজোর জলসায় তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট দাদাভাই শ্রদ্ধেয় পান্নালাল ভট্টাচার্য্যের শ্যামাসংগীতের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন।ভক্তি রসাশ্রিত সে-ই কালজয়ী সঙ্গীতরাশির মধ্যে অনুরাগীদের উন্মাদনা অধিকতর বৃদ্ধি করেছিল__* ভাবতে যদি সময় গেল,ডাকতে পেলাম কই,* ভজ হরিপদ পঙ্কজ যুগলম এবং * আমি মনের মত পাগল পেলাম না, গানগুলি ।

১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি।পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় তাঁকে।যুগান্তরের যাত্রাপথে বাঙালির ভাই - ভাইয়ের বিরোধ স্তব্ধ হয়ে চলবে তাঁর নয়ন ভরা জলের আবেগে আর তাঁকে এত আপন করে পেয়ে হারাবার ভয়ে।

https://youtu.be/yEasVa9hVKQ?si=yMzRJzh8Dzu7GknD

চিরতরে প্রস্থান হয়নি তাঁর । তাঁকে শতকোটি প্রণাম।

" তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা / কোনখানে রাখবো প্রণাম।" 

🙏







মন্তব্যসমূহ

  1. ✍️ বিদ্রোহী কবির আসন্ন জন্মদিন উপলক্ষ্যে জাতি - বর্ণ - ধর্ম নির্বিশেষে আবাল - বৃদ্ধ - বনিতার সঙ্গে বিনিময় করলাম চলতি পথে প্রিয়ার শ্রদ্ধাঞ্জলি।সকল সাথীর সুস্থতা কামনা করি।
    ধন্যবাদ।
    🙏

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দ্বীপান্তরের অন্তঃপুরে

জাগো সবলা !