রসনায় রসায়ন
" খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে_ খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে। যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে, জড়ো করে আনি সব _ থাক সেই আশাতে। ডাল ভাত তরকারি ফল - মূল শষ্য, আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য, রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি, ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,"
' মন্ডা ' সমিতির ' উহ্যরাম পন্ডিত '- এর হাত ধরে ঢুকে পড়লাম শারদীয়া হেঁশেলে।'আপ রুচি খানা পর রুচি পর না' চাঠগাইয়া আঞ্চলিক প্রবাদটি এখন কি আর মানতে পারে কেউ! নৈব নৈব চ।সাম্প্রতিককালে শিশু - যুবা - বৃদ্ধ সকলেই চিকিৎসক কিম্বা অন্য উপদেষ্টার নিয়মে সুস্থ,সুন্দর থাকতে ও আয়ুবৃদ্ধির তাড়নায় ছকে বাঁধা খাবার খেতে ও খাওয়াতেই আগ্রহী এবং প্রায় অভ্যস্ত হবার পথে।সেই খাদ্যগুলি যদি হয় উপাদেয়, একটু রূপসী আর চটজলদি প্রস্তুতযোগ্য, তবে খেয়ে ও খাইয়ে আরাম। সকালে নিদ্রাভঙ্গের পর থেকে রাতের শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত মাপে মাপে প্রয়োজনীয় খাবারগুলি বিবিধ ঢঙে গ্রহণ করে চলেছেন প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, তাই তো!
সত্যি বলতে যুগে যুগে কবি - সাহিত্যিকেরা এই খাবার নিয়ে নানান আন্তরিকতার ছোঁয়া রেখে গেছেন আমাদের জন্য। সর্বাগ্রে মনোদর্শনে ভেসে ওঠে রবি ঠাকুরের ছোটবেলার স্বপ্ন মেশা অমর কথাকটি," আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ পিপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।" কাব্যি করেছেন আমসত্ত্ব, দুধ, কলা আর সন্দেশ নিয়ে। অথচ নিয়ম করে খেতেন নিমপাতার সরবৎ। মাত্র বারো বছর বয়সে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে যাবার পর থেকে বাকি জীবন ধরে বহু দেশ ঘুরেছেন।আর নানা দেশের ভাললাগা খাবারগুলি সময় সুযোগমত চালু করেছেন ঠাকুরবাড়ির হেঁশেলে। ইউরোপের একরকম কন্টিনেন্টাল ফ্রুট স্যালাড এভাবেই তিনি বয়ে নিয়ে আসেন ঠাকুরবাড়িতে, অবশেষে তাঁর লেখনীর দৌলতে বঙ্গবাসীর পাতে।তাঁর ' পেটে ও পিঠে ' , ' ইঁদুরের ভোজ ', গল্পের মিঠাইয়ের ঝুড়ি,পয়লা নম্বর গল্পের মাছের কচুরি আর আমড়ার চাটনী আজও প্রীত করে আমাদের চিত্তরসনাকে।
' বিনি পয়সার ভোজ '- এ পাই ' কী বললি? বাবু হোটেল থেকে খাবার কিনে আনতে গেছেন? বলিস কী রে। আজ তবে তো রীতিমত খানা! খিদেটিও দিব্যি জমে এসেছে।মটন চপের হাড়গুলি একেবারে পালিশ করে হাতির দাঁতের চুষিকাঠির মতো চকচকে করে রেখে দেব। একটা মুরগির কারি অবিশ্যি থাকবে _ কিন্তু, কতক্ষণই বা থাকবে।আর দু রকমের পুডিং যদি দেয় তা হলে চেঁচেপুচে চীনের বাসন গুলোকে একেবারে কাঁচের আয়না বানিয়ে দেব। যদি মনে করে ডজন দুত্তিন অয়স্টার প্যাটি আনে তা হ'লে ভোজনটি বেশ পরিপাটি রকমের হয়।আজ সকাল থেকে ডান চোখ নাচছে,বোধ হয় অয়স্টার প্যাটি আসবে।' ভাব গম্ভীর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল অন্তরের ছেলেমানুষটি,ঠিক যেমনটি ঘটে এ যুগের ভোজন - বিলাসীদের ক্ষেত্রেও।
১৮১৩ সালে কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন।আগের বছর লন্ডনে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সেদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। খাদ্যতালিকা প্রস্তুত হয়েছিল কবির পছন্দে।এই তালিকায় ছিল গ্রীন ভেজিটেবল স্যুপ,ক্রীম অফ টোম্যাটো স্যুপ, স্যামন্ড ইন হল্যান্ডেন সস অ্যান্ড কিউকামবার , প্রি সল্টেড ল্যাম্ব উইথ গ্রীন ভেজিটেবল,রোস্টেড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই,গ্রীন স্যালাড ও আইসক্রীম।
দেশী খাবারের মধ্যে কবির পছন্দে ছিল কাচা ইলিশের ঝোল,চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ী।এছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন।এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব,হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব ও চিকেন কাবাব নোসি। কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে কবি - পত্নী মৃণালিনী দেবীর সেই কবিখাদ্যময় রসুইঘরটি।
বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস মোতাবেক ভেতো বাঙালির ভাতের অভ্যাসের উৎস আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠী।চর্যাপদে গরীব বাঙালির মুখের কাঁদুনী 'হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী ', ঘরে ভাত নেই তবু অতিথির আনাগোনার কমতি নেই। প্রাচীন উচ্চবিত্ত বাঙালির প্রিয় খাদ্য ছিল হরিণের মাংস। চর্যাপদে লেখা আছে, ' আপনা মাংসে হরিণা বৈরী '।প্রাচীন, মধ্য,আধুনিক ও ভবিষ্যতের হাতছানি দেওয়া খাবারগুলি ব্যক্তিগতভাবে রসনার কথাই বলে চলে। সাহিত্য সমকালীন সমাজের অন্য সব কিছুর সঙ্গে খাদ্য - সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবিও ধরে রেখেছে যুগে যুগে। কবিগুরু ছাড়াও সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, সৈয়দ মুজতবা আলী ও আরও বিদগ্ধ জনেদের রচনাতেও সেই ছবিই আঁকা আছে যুগান্তরের বাঙালিদের জন্য।মঙ্গলকাব্য গুলিতেও রয়েছে সেকালের খাদ্যাভ্যাসের বিবরণ।
হিউয়েন সাঙ,মানুচি, মানরিক, ইবনবতুতাদের লিখিত গ্রন্থ থেকেও বাংলা তথা ভারতের সেকেলে খাওয়া দাওয়া সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলা পাঠে লজ্জা,ঘেন্না,ভয়_ তিন থাকতে নয়, নয়,নয়! বাঙলায় লেখা বাঙালির রত্নরাজি,অন্ততঃ রসনাতৃপ্তির কারণেও সন্ধান করা উচিৎ উত্তরসূরীদের দ্বারা।বাংলার খাদ্য - সংস্কৃতি ও বাঙালির ভোজন-আভিজাত্য বাঁচাতে তাই প্রয়োজন নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করা।
প্রাসঙ্গিক আমার প্রিয় রন্ধন-নক্ষত্র রেনুকা দেবী চৌধুরাণীর কথা বলি। মাত্র দশ - এগারো বছর বয়সে বৈবাহিকসূত্রে প্রবেশ করলেন জমিদার বাড়িতে। সেই থেকে ছিয়াত্তর বছর বয়স পর্যন্ত যত রান্না শিখেছিলেন ও উদ্ভাবন করেছিলেন, তার সবই লিখে রেখেছেন আমাদের জন্য।আধুনিক যন্ত্র নির্ভর রান্না তখন ছিল না।আপন খেয়ালে মুখ বদলের রান্নায় এমন পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁর রন্ধনের স্বাদ গ্রহণ করে প্রশংসা করেছেন সদ্য পিতৃদেব স্বর্গীয় মোতিলালকে হারানো জওহরলাল; সঙ্গে নিমন্ত্রিত ছিলেন সরোজিনী নাইডুও। উভয়ই ভীষণ সন্তোষ লাভ করেন রেণুকাদেবীর নিষ্ঠাভরা নিরামিষ রান্নার জাদুতে।
গান ভালবেসে গাইলে যেমন কন্ঠস্বর দরদী বোধ হয়, অনুরূপে ভালোবাসা মেশানো রন্ধনের বেলাতেও খাবারটি অতি উপাদেয় লাগে।এর জলজ্যান্ত উদাহরণ,জী বাংলায় সুদীপার রান্নাঘরেই মেলে। সুদীপাদেবী অসাধারণ ধৈর্য্য,নিষ্ঠা ও পারিপাট্যের সঙ্গে অপরাপর রন্ধন বিশেষজ্ঞদের সাথে সংযোগ রক্ষা করে বিবিধ রন্ধন কৌশলাদি পরিবেশন করে চলেছেন।এটি আধুনিক যুগের জল গড়াতে অপটু কন্যা থেকে শুরু করে অশীতিপর রমণীর নিকটও আদরণীয়, গ্রহণযোগ্য এবং সুফলদায়ী।এধরনের একটি উদ্যোগ জী বাংলার জনপ্রিয়তাকে ঊর্ধ্বগামী করেছে, নিঃসন্দেহে।
কথাপ্রসঙ্গে রন্ধন পটিয়সী শ্রীমতি অনিমা গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিভার উল্লেখ করব।তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারী থেকে পাঠ সম্পন্ন করবার পর ওই অল্প বয়সেই মধ্য কলকাতায় চলে আসেন বৈবাহিকসূত্রে। চুরাশি বছর বয়সে ত্রিশের তরুণীসম দক্ষা।আর দেশি - বিদেশী নানান খাবারের মেলবন্ধনে সু - স্বাস্থ্য কবচ ছুঁইয়ে অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে নাতি - পুতি, আত্মীয় - প্রতিবেশী সর্বজনের রসনার তৃপ্তি সাধন ঘটিয়ে চলেছেন আজও। পরিচিত গৃহকর্ত্রীরা তার পরামর্শ ব্যতিরেকে রান্নায় অভিনবত্ব ঘটানোর কথা ভাবতেই পারেন না। সাক্ষাৎকারকালে, চটজলদি স্বাস্থ্যকর ব্রেকফাস্ট হিসেবে নির্দেশ দেন স্যান্ডউইচের।
ইতিপূর্বে ছিলাম ভেতো বাঙালির পাতি রান্নাঘরে।তাই আলোচ্য খাবারটির বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।
দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডের স্টোর নদীর উপর অবস্থিত কেন্ট প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্গত ডোভার জেলার এক উপকূলবর্তীয় ঐতিহাসিক শহর স্যান্ডউইচ।John Montague ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ।১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দশ বছর বয়সে অর্জন করেন ' আর্ল অব স্যান্ডউইচ ' খেতাব। সুদক্ষ প্রশাসনিক হবার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন নামকরা জুয়াড়।ওই খেলার সময়ে তিনি আহার নিদ্রার জন্য সময় ব্যয় করতে চাইতেন না। দু'টি রুটির টুকরোর মাঝখানে স্লাইসড মাংসের টুকরো ভরে খেতেন।তার জুয়াড়ী বন্ধুরাও ঐ রীতি অনুসরণ করতে থাকেন। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ভ্রমণকালে তুর্কী ও গ্রীকদের তিনি অবশ্য দেখেছিলেন দু'টি রুটির মধ্যে মাংস, পনীর ইত্যাদি ভরে খাওয়ায় চল।
জন ছিলেন ইংরেজ।তবু আমেরিকানদের খাবারটির প্রতি অধিক ভালোবাসার কারণে প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন অর্থাৎ ৩ রা নভেম্বর তারিখটিকে 'স্যান্ডউইচ ডে' হিসেবে পালন করে তারা।আমেরিকার যেসব খাবারের দোকানে স্যান্ডউইচ বিক্রী হয় সেখানে ক্রেতাদের জন্য দিবসটি উপলক্ষ্যে নানান আকর্ষণীয় উপহার ও ছাড়ের সুযোগ থাকে। স্যান্ডউইচ নামকরণের পূর্বে এটি রুটি - মাংস বা রুটি - চীজ নামে পরিচিত ছিল।
সময়ের সাথে সাথে আজ অবশ্য স্যান্ডউইচ পরিবেশনের ধরন ও উপকরণের ভিন্নতা অনুযায়ী নামেও অনেক পরিবর্তন এসেছে; যেমন ক্লাব স্যান্ডউইচ,জেলি স্যান্ডউইচ, পি নাট বাটার অ্যান্ড জেলি স্যান্ডউইচ,সাবমেরিন স্যান্ডউইচ সহ আরও নানা রকম স্যান্ডউইচ রেস্তোঁরাগুলিতে পরিবেশিত হয় ভিন্ন স্বাদ আর স্টাইলে।
যৌথ পরিবার আজ বিলুপ্তপ্রায়।অধিকাংশ পরিবারে আবার একটি মাত্র শিশুর অধিষ্ঠান।তাদের বায়নাক্কা সামলাতে নাস্তানাবুদ মাতৃশক্তি! তবু বলি,
আবাল - বৃদ্ধ - বনিতা মাঝেই একটি শিশু আছে; খোলস ছেড়ে বাইরে এসে খাদ্য - বিলাসে বাঁচে । সত্যিকারের দুরন্ত মন জব্দ হতেই পারে ; চাবি কাঠিটি রন্ধনশালে জাদুতে মন কাড়ে ।
প্রিয় পাঠক বন্ধুদের খাদ্য বিলাসিতার বৃক্ষ থেকে অবতরণের মইটি নিবেদনের কারণে মার্জনা ভিক্ষা করে নিলাম।
চোখ ,কান,নাক, ত্বক জাগ্রত রেখো; সাবধান _ রসনায়, সব নাহি চেখো! মন যদি নাই ভরে, আবেশটা মেখো; স্বাস্থ্যটা ভাল থাক, স্বপ্নেই দেখো!!
********************🙏***********************
ভোজন বিলাসী বন্ধুরা, টক, ঝাল, মিষ্টির হ্রাস - বৃদ্ধি বিষয়ক সংযোজনে চলতি পথে প্রিয়া নিবেদিত রসনায় রসায়নের স্বাদজনিত সমৃদ্ধিতে সহায়ক হবেন, আশা রাখি।🙏
উত্তরমুছুন